ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

৩২ নম্বর বাড়ি, বাঙালি জাতির অনন্ত শোকের জাদুঘর

৩২ নম্বর বাড়ি, বাঙালি জাতির অনন্ত শোকের জাদুঘর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের তিল তিল করে গড়ে তোলা, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে তাঁরই রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেই ভয়াল রাতে মীরজাফরের দল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেদিনের সেই ঘাতক সৈনিকরা এই বাড়িতে এসে প্রথমেই নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামালকে এবং নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমের কাছে শেখ নাসেরকে হত্যা করে। এরপর খুনিরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে থাকলে, তখন গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির কাছে এগিয়ে আসেন। শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে সামনে পেয়ে, তখন খুব কাছ থেকে গুলি করে তাঁকেও হত্য করে। ঘাতকের হাতে উদ্যত স্টেনগানের বুলেটে সেদিন জাতির পিতার তলপেট ও বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। 

প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গা ছিল, তার তিন-চার ধাপ উপরে তিনি রক্তাক্ত নিথর দেহে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চশমা ও তামাকের পাইপ পড়েছিল সিঁড়ির কাছাকাছি আরেক ধাপে। বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গিয়েছিল। সারা শরীর রক্তে ভেজা পাঞ্জাবির রং ছিল গাঢ় লাল। একটি বুলেট তার ডান হাতের তর্জনীতেও লেগেছিল। হত্যাকারি হায়েনারা তখন বঙ্গবন্ধুর লাশ টপকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে শেখ জামালের ঘর, শেখ রেহানার ঘর, পাশেই শেখ হাসিনার ঘর, তিনতলায় শেখ কামালের ঘর, একে একে ঘাতকরা সবকটি ঘরের সবকিছু তল্লাশি ও ওলট-পালট করেছে। তছনছ করেছে ঘরের মূল্যবান আসবাব, তসবি জায়নামাজ মেঝেতে ফেলে বুটের তলায় মারিয়েছে। 

সেদিন ওরা যেন কারবালার ময়দানের মতোই তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে বাড়ির প্রতিটি কক্ষে, টয়লেটে, বারান্দায়। ঘরের সর্বত্রই তন্ন তন্ন করে সবাইকে খুঁজে বের করে, ভেতরে যেখানে যাকে পেয়েছে, সেখানেই তাকে হত্যা করেছে। সেইরাতে গুলিগোলার আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত বাড়ির মহিলা সদস্য সবাই বঙ্গবন্ধুর ঘরে একত্র হয়েছিলেন। আর সেখানেই খুনিরা বেগম মুজিব, পুত্রবধূদ্বয় সুলতানা কামাল খুকু, পারভীন জামাল রোজী এবং শেখ জামালকেও পরিবারের অন্যান্যদের মতোই বঙ্গবন্ধুর ঘরের মূল বেডরুমে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সেদিন ৩২ নম্বর বাড়ির ভেতরে ড্রইং রুমের তা-বলীলায় মেশিনগানের ছোড়া গুলির আঘাতে অ্যাকুরিয়ামের উচ্ছ্বলিত রঙিন মাছগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রক্তের উষ্ণতায় ছটফট তড়পাচ্ছিল! তখন মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে, বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে ছোট্ট রাসেলকেও নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে তাকেও হত্যা করে। শিশু রাসেলের পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। হত্যাকারিরা রাসেলকে খুন করে তুলে এনে মূল বেডরুমে তার দুই ভাবির লাশের মাঝখানে ফেলে রেখেছিল। নিষ্ঠুর শত্রুরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকল সদস্য ছাড়াও একজন টেলিফোন অপারেটরকে নিচতলায় হত্যা করে এবং সেখানেই তার মৃতদেহ পড়েছিল। ইতিহাসের ঘৃণ্য-বর্বর গুটিকয় সেনাবাহিনীর মোশতাক গংয়ের সদস্যরাই বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির এই হত্যালীলা চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মেজর চক্রকে আইনের হাত থেকে রক্ষার জন্য স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেছিল।

বলা যায়, গত শতকের ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ এর ১৪ আগস্ট- এই ১৫ বছর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির এই বাড়িটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালিয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধু এই বর্বরতার খবর শুনে, তখনি তিনি এই বাড়ির নিচতলার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে রাত সাড়ে ১২টায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা ঘোষণার খবর সেদিন ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর সেদিনই, ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে (২৫ মার্চ রাত দেড়টায় তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।  

পঁচাত্তরের ১৫-আগস্টের পর এই বাড়ির সমস্ত আলো বহুবছর নিভে গিয়েছিল। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তে ভেজা ধানমন্ডির এই বাড়িটি ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাতির জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বর্তমানে এ বাড়িটি এখন এই জাতির অনন্ত শোকের জাদুঘর। প্রতিদিন এখানে শত শত দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই থাকে। অথচ এই বাড়ির সমস্ত দেয়ালে এখনও খুনিদের ধ্বংসের চিহ্ন। হয়তো এসব দেখতে গেলেই মনে হয় যেন, আগস্টের সেই নিশুতি রাত এখনো থমকে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের ৪৫ বছর কেটে গেছে। তবুও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি এখনও ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় সেই দিনটির সাক্ষ্য দেয়।

১৫-আগস্ট ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, হত্যা করতে চেয়েছে বাঙালির আদর্শ ও বঙ্গন্ধুর দর্শনকে। এদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নকে টুটি চেপে হত্যা করেছে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বাঙালির মন থেকে মুছে দিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীনতার সমস্ত অর্জনকে। হয়তো ঘাতকরা এ-ও ভেবেছিল, বাঙালি জাতির হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বঙ্গবন্ধু  হত্যার মধ্য দিয়েই রুখে দিতে পারবে। কেননা, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে পঁচাত্তরের পর জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, তার পরিণতিতেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জাতির পিতাকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতানার বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তানি ও তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। অথচ ওরা একবারও ভাবেনি যে, দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় কত সংগ্রাম, কত রক্তস্রোত, কত বেদনা, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ণ সইতে সইতে...বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে রচিত হয়েছে এই বাংলার বিজয়। ফলে, এই বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকার অধ্যায় এতো সহজে নস্যাৎ করা সম্ভব নয়।

যদিও, ১৫ আগস্টের পর থেকে স্বাধীনতার ভিত্তি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করে দেশটাকে আবার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছে এবং তারাই কি আজও সেই ষড়যন্ত্র করছে না? এইসব দানবরাই তো, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে দীর্ঘ ২১ বছর নির্বিচারে শাসন ও শোষণ চালিয়েছে। পবিত্র স্বাধীনতার ভাবমূর্তি সর্বত্রই নষ্ট করেছে। একাত্তরের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যে স্বতন্ত্র দেশ পেয়েছি, আমাদের সৌভাগ্য আজ তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটু একটু করে নির্মিত হচ্ছে উন্নয়নশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভবিষ্যত। প্রতি বছর ১৫-অগাস্ট বাঙালির জীবনে জাতীয় শোকদিবস হয়ে আসে। আর বিনম্র শ্রদ্ধায় বাংলাদেশের মানুষ আজও মনেপ্রাণে স্মরণ করে মহান জাতির পিতাকে। কারণ, ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না। ভুলতে পারবেও না। তাই তো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি এক ট্রাজেডির ইতিহাস। যে ইতিহাস আজীবন মানুষের অন্তরে গেঁথে থাকবে অনন্তকাল...।

## লেখক : 
হেনরী স্বপন
কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।
 


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন