ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

ইনডেমনিটি বাতিল ও জাতির কলঙ্ক মোচন

ইনডেমনিটি বাতিল ও জাতির কলঙ্ক মোচন
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৪ বছর প্রতীক্ষার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেননা, এই রায়ের মাধ্যমেই ১৫-আগস্টের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার করা সম্ভব হয়েছিল। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলে, দেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং  প্রতিক্ষিত বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তি ঘটে। 


কিন্তু কেন আমাদের এই ন্যায় বিচারের জন্য ৩৪-বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে? কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মেজর চক্রকে আইনের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬-সেপ্টেম্বর  খন্দকার মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর এবং মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর ছিল। 

অধ্যাদেশটিতে তখন দুটি ভাগে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, প্রথম অংশে : ১৯৭৫ সালের ১৫-আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না এবং দ্বিতীয় অংশে ছিল: রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এখানেই শেষ নয়। এরপর এই বিচারকে কবরস্থ করতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫-আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯-এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল প্রকার অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দিয়েছিলেন।


তখনকার পঞ্চম সংশোধনীর সেই সংবিধান আইন ১৯৭৯'তে বলা ছিল, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯-এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দ-াদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা সমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”


এভাবেই, জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫-আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীদের দায়মুক্তির সমস্ত পথ সুগম করেছিলেন। কেননা, মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা না পেলে ১৯৭৯ সালের ৯-এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫-আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে সবরকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। যদিও ট্রাজেডির এখানেই শেষ নয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল  করেননি। ফলে দায়মুক্তির আনন্দে তখন ১৫-আগস্টের খুনিরা হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন।

এরপর দীর্ঘ ২১-বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২-জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ওই বছর ২৩-জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আর তখনই প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু করা হয়েছিল। প্রথমত এই বিচারের আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া হয়। এরপর সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিলটি তখন, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন হয়। ১২-নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয় এবং একই সাথে ১৪-নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর বিলটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে, মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সংসদে বৈধতা দেওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি তখন সম্পূর্ণভাবে বাতিল বলে গণ্য হয়। তারপর ধানমন্ডি থানায় ১৯৭৫ সালের ১৫-আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করে, তবেই সমস্ত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার আরম্ভ হয়। 

কিন্তু বিচারিক নানা টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে ৮-বছর পেরিয়ে গেলেও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বেঞ্চ গঠনে তৈরি হয় ষড়যন্ত্রের জাল ও অচলাবস্থা। থমকে যায় এর বিচারকাজ। ইতোমধ্যে আবার ২০০১ সালের অক্টোবরে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাজনৈতিক মিত্রদল বিএনপি এবং বিশেষ করে একাত্তরের ঘাতক-যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী জোটের ইশারায়, স্থবির বিচারালয়ে বিচারের বাণী আবার নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তখন পুনরায় ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করবে, এই অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালের ৬-জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার শপথগ্রহণ করে। ফলে উন্মোচিত হয় বিচার সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
অবশেষে, মামলাটিকে প্রলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য আসামিপক্ষের সমস্ত হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং প্রলোভন সত্ত্বেও আদালত আর পিছু ফিরে তাকাননি। মাথা নত করেননি কোনও দানব শক্তির ভয়ে। বরং সমস্ত বাধা বিপত্তির মুখেও বিচারকগণ ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ভিত্তি স্থাপন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন। এভাবেই তৎকালীন বিচারিক আদালত সকল প্রকার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯৯৮ সালের ৮-নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। 

এই রায়ে দোষীসাব্যস্ত আসামিরা হলেন (০১) লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (০২) লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, (০৩) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), (০৪) পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ, ৫. পলাতক আসামি মেজর বজলুল হুদা, ৬. পলাতক আসামি লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (০৭) পলাতক আসামি মেজর শরিফুল হোসেন ওরফে শরফুল হোসেন, (০৮) পলাতক আসামি লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী, (০৯) পলাতক আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), (১০) পলাতক আসামি লে. কর্নেল এসএইচএসবি নূর চৌধুরী, (১১) পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা, (১২) পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, (১৩) পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, (১৪) পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, (১৫) পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিনকে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মৃত্যুদণ্ড দেন। 

তবে বঙ্গবন্ধুর এই আত্মস্বীকৃত খুনিদের ভাবাদর্শগত রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি, বিশেষত: জিয়াউর রহমান এবং তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেও বঙ্গবন্ধুর এইসব খুনিদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেনি, বরং বরাবরই বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে এরা আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিনও হরতাল পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রতি এদের এতোটাই অশ্রদ্ধা ছিল! যা সত্যিই দুঃখজনক। 


পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের সাহসী পদক্ষেপে আইনের সব প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক নিয়মে সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৭-জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিদের সাজা কার্যকর করা হলে বাংলাদেশের মাটি বহু বছরের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয় এবং ২০০৯ সালের ১৯-নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলে, তবেই এই জাতির পক্ষে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কাঙ্খিত ন্যায়বিচার। তাই, আজ বলতে চাই,...
‘পিতা, আমাদের ক্ষমা করো,
তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শক্তি।’

##
লেখক : হেনরি স্বপন- কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন