ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news
সুগন্ধা ও বিষখালী তীরে নির্মাণ হয়নি নৌ ফায়ার স্টেশন

ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির দুই বছর আজ

ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির দুই বছর আজ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন


আজ ২৪ ডিসেম্বর। ঝালকাঠিতে লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের দুই বছর। দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের প্রাণহানি আর অসংখ্য মানুষ অগ্নিদগ্ধের সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করে আজও আঁতকে ওঠেন সেদিনের স্বজনহারা ও আহত মানুষগুলো। 
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর গভীররাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর তীরে নৌ ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হয়নি। 
বাংলাদেশের ইতিহাসে নৌ অগ্নিকান্ডের দুঃসহ বিভীষিকাময় স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দিয়াকুল গ্রাম। ২৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা সদরঘাট থেকে ৬ শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় অভিযান-১০ লঞ্চ। 


গভীর রাতে লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর মোহনায় এলে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে নদীর মধ্যে পুরো লঞ্চ জ¦লছিলো। পরে ভাসতে ভাসতে দিয়াকুল এলাকার চরে আটকা পরে লঞ্চটি। ততক্ষেণে অনেকেই পুড়ে আঙ্গার। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন। 
এ ঘটনায় ৩৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে নদী থেকে ৪ জনের লাশ উদ্ধার এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়। 
লঞ্চ ও নদী থেকে অগ্নিদগ্ধদের উদ্ধার এবং তাদের আশ্রয় ও সেবা দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন দিয়াকুল গ্রাম ও ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকার লোকজন। সেই দিনের ভয়াল স্মৃতির কথা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠেন তাঁরা।


এ ঘটনায় স্বজনহারা মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি ঝালকাঠি থানায় লঞ্চের মালিকসহ ৮ জনের নামে মামলা করেন। পরবর্তীতে মামলাটি নৌ আদালতে হস্তান্তর করা হয়। পোড়া লঞ্চটি আদালত মালিক পক্ষের জিম্মায় দেন।
জানাযায়, সুগন্ধা-বিষখালী-ধানসিঁড়ি-গাবখান, এই চার নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে ঝালকাঠি বন্দর। খুলনা ও মোংলা বন্দরে প্রবেশের জন্য রয়েছে দেশের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক কৃত্রিম চ্যানেল। 


এই নৌ পথ দিয়ে প্রতিদিন জাহাজ ও লঞ্চের পাশাপাশি ছোট বড় অসংখ্য নৌযান বরগুনা, খুলনা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নৌ বন্দরে চলাচল করে। ঝালকাঠি ঘাট থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যায় একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ, একই দিন ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে একটি।  
এছাড়াও সপ্তাহে তিনদিন স্টিমার চলাচল করে ঢাকা-খুলনা রুটে। ঝালকাঠি ঘাট থেকে স্টিমারও যাত্রী নেয়। ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এই শহরকে এক সময় দ্বিতীয় কোলকাতা বলা হতো। সুগন্ধা নদীর তীরেই রয়েছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানির তেলের ডিপো। নদী পথেই কার্গোতে আসে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল। ঝালকাঠির সেই নদী পথই এখন অরক্ষিত। লঞ্চ ও জাহাজে অগ্নিকান্ডের ঘটছে প্রাণহানি। 


এদিকে ঝালকাঠিতে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় শ্রেণির একটি ফায়ার স্টেশন। গত ৬ বছর আগে এটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা প্রস্তাব পাঠানো হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। 
তাই এই জেলার নৌপথে অগ্নি দুর্ঘটনায় দ্রæত নির্বাপণের ব্যাবস্থা নেই বলে মনে করছেন ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। নৌ পথে অগ্নিকাÐ কিংবা অন্য যেকোন দুর্ঘটনায় যেন এতো হতাহতের ঘটনা না ঘটে, এ জন্য সুগন্ধার তীরে একটি আধুনিক নৌ ফায়ার স্টেশন নির্মাণের দাবি জানিয়েছে ঝালকাঠিবাসী।  
ঝালকাঠি সদর উপজেলার তারুলী গ্রামের শাহীন আলম বলেন, আমি ঢাকায় চাকরি করি। প্রায়ই গ্রামের বাড়িতে আসা যাওয়ার জন্য লঞ্চে উঠি। আগে লঞ্চকেই নিরাপদ ভাবতাম, এখন দেখি প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। 


লঞ্চে অগ্নিকাÐের পর এখন থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে যাত্রা করি। নদীপথে কখন দুর্ঘটনা হয় কে জানে, নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই লঞ্চে। তাই ঝালকাঠি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এখানে চার নদীর মোহনা রয়েছে। প্রতিদিন শত শত নৌযান চলাচল করছে। এখানে নৌ ফায়ার স্টেশন থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। 
সুগন্ধা নদী তীরের লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, নৌযানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে আমাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বরিশাল থেকে নৌ ফায়ার সার্ভিসেরকর্মীদের ঝালকাঠি আসতে ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে। 


ততক্ষণে আগুনে পুরো জাহাজ পুড়ে যায়। নদী তীরের মানুষের একটাই দাবি, ঝালকাঠিতে একটি নৌ ফায়ার স্টেশনের। 
নদী তীরের বাসিন্দা ট্রলারচালক মিলন খান বলেন, ২৪ ডিসেম্বর রাত থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত লঞ্চে অগ্নিকান্ডের আহত ও দগ্ধ যাত্রীদের পারাপারের কাজ করেছি। বিনা ভাড়ায় প্রায় তিনশ যাত্রীকে তীরে পৌঁছে দিয়েছি। যদি নৌ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন এখানে থাকতো, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
এমভি ফারহান ৭ লঞ্চের ঝালকাঠির ঘাট সুপারভাইজার মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, প্রতিদিন ঝালকাঠি থেকে পাঁচ-ছয়’শ যাত্রী ঝালকাঠি থেকে ঢাকা ও ঢাকা থেকে ঝালকাঠি যাতায়াত করে। লঞ্চে অগ্নিকান্ড নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। 


ঝালকাঠি জেলার মধ্যে সুগন্ধা, বিষখালী ও গাবখান নদীতে কোন নৌযানে আগুন লাগলে বরিশাল থেকে নৌ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও ডুবুরি দল আসতে যে সময় লাগে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নদী তীরে যদি স্পিডবোট ও ডুবুরি দলসহ একটি নৌ ফায়ার স্টেশন থাকে, তাহলে দ্রæত এসব দুর্ঘটনা রোধে কাজ করা সম্ভব। 
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ঝালকাঠি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এখানে লবনের কারখানা রয়েছে, আছে তেলের ডিপো। প্রতিদিন লঞ্চ, স্টীমার ও জ্বালানি তেলের হাজাজসহ ছোটবড় শত শত নৌযান চলাচল করে। 


এখানে একটি নৌ ফায়ার স্টেশন দরকার। কারণ আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির একটি ফায়ার স্টেশন আছে। এখানে জনবল সংকট রয়েছে। নেই আধুনিক কোন সুযোগ সুবিধা। ডুবুরি দল নেই, জরুরি বের হওয়ার জন্য স্পিডবোট নেই। আমরা ছয় বছর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসকে প্রথম শ্রেণির করার দাবি করেছিলাম, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। 
ঝালাকঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন বলেন, নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুগন্ধা নদীর তীরে নৌ ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নৌ ফায়ার স্টেশন থাকলে নৌ দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রæত ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাজ শুরু করতে পারবে। 


এমএন
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন