রিজার্ভ আরও ২২ বিলিয়ন ডলার কমার শঙ্কা!


চলতি বছরের শেষে বাংলাদেশকে ২০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর আকুর বিল দিতে হবে ২ বিলিয়ন ডলার। সবমিলিয়ে বছর শেষে আরও ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমান বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রয়েছে ২০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন স্বল্পমেয়াদী ও বাকি ৭৫ দশমিক ২১ বিলিয়ন দীর্ঘদেয়াদী ঋণ। এ বছরের মধ্যেই শোধ করতে হবে স্বল্পমেয়াদী ২০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন।
কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই অর্থ পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত যোগান নেই বাংলাদেশের। বিদেশী উৎস থেকে নেওয়া ঋণগুলো ফেরত দিতে না পারলে বাংলাদেশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হবে। অথবা স্বল্পমেয়াদী এসব ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ফলে দেশের রিজার্ভে সরাসরি প্রভাব পড়বে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, বিদেশী উৎস থেকে দেশের উদ্যোক্তারা সারাবছর ঋণ দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই থাকেন। কিন্তু আগের দেনা পরিশোধ না করলে নতুনভাবে ঋণ পাওয়ার সম্ভবনা কমে যায়। অর্থাৎ স্বল্প মেয়াদী ঋণগুলো পরিশোধ করে নতুন করে আবার ঋণ পাওয়া যাবে। তবে সমস্যা হলো এই স্বল্পমেয়াদী ঋণ শোধের জন্য পর্যাপ্ত যোগান নেই। কারণ ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। আর বিকল্প উৎসের নাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় করছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জরুরি সরকারি প্রকল্প ছাড়া ডলার ছাড় করা হচ্ছে না। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ৪৮৯ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয়েছিল ৭৬২ কোটি ডলার। বিক্রীত ডলারের ৯০ শতাংশ খরচ হয় জ্বালানি ও সার আমদানিতে। এর ফলে বর্তমানে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলারে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২ সাল শেষে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকতে পারে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকিটা পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়েও প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের শর্ত। তাদের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ গননা করলেই তারা সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিবে। সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাব করলে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার কমে আসবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানি কমিয়ে আনতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ডলারের এক দাম নির্ধারণ করে দেওয়া। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের পরামর্শ মেনে একবারে ৮০০ কোটি ডলার না কমিয়ে রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্য প্রকাশ করতে পারে। এতে বিভ্রান্তি দূর হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ ডলারের পাশাপাশি বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ রাখা হয়েছে ডলারে। আবার রিজার্ভের অর্থে দেশেও তহবিল গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। এ ছাড়া রিজার্ভের অর্থে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)।
উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ বিমান ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে রিজার্ভ থেকে। পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ খরচ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন তহবিল ও প্রকল্পে রিজার্ভের আট বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে সফরকারী দলটি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসাব করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়েছে। আইএমএফের পরামর্শ মেনে রিজার্ভ হিসাব করা হলে তা কমে দাঁড়াবে ২৭ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। বিভিন্ন খাতে দেওয়া রিজার্ভের অর্থ হিসাব থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (বিআইডিএফ) কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন না করার কথাও বলেছে সংস্থাটি।
রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হলো সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা ডলারের মজুত বাড়ানোর প্রধান উৎস। এখন মজুতের জোগানে টান পড়তে শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই মাসের তুলনায় সোয়া ৬ শতাংশ কমেছে। টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বাড়তির দিকে ছিল, যা অর্থনীতিকে স্বস্তি দিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি ৭ শতাংশের মতো কমেছে। তবে সার্বিক রপ্তানি আয় এখনো ইতিবাচক ধারায় আছে। অর্থবছরের তিন মাসের হিসাবে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে রপ্তানি আয় ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার হয়েছে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কা এবং ডলার সংকটের কারণে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ নিম্নমুখী হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৫৪ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে, যা বিগত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ডলার দেশে এসেছিল। গত অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে ১৭৫ কোটি এসেছিল। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় সেই গড়ের নিচে নেমে গেল।
কয়েক মাস ধরে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ কমার পর এবার বিদেশি সহায়তার খাতটিও সেই পথ ধরেছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে আগের মতো আর বৈদেশিক সহায়তা ছাড় হচ্ছে না। যার কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৯ কোটি ডলার কম ঋণসহায়তা এসেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিদেশি ঋণ আসাও কমে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ ডলারের ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।
অবশ্য গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ সহায়তা এসেছিল, যা ছিল গত জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খায়। ওই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করে দাতারা, যা ছিল আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে এসেছে ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
এএজে
