সাপের বন্ধু 'টাইগার জাকির'

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন। সেই সূত্রে পেশায় তিনি জেলে। সুতরাং মাছ ধরেই তার সংসার চলে। মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে, তাই পেশায় পড়েছে টান।
কার্যত বেকার জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। কিন্তু আরেক কাজে মাঝেমধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। লোকালয়ে ছুটে আসা বিষধর সাপ ধরছেন! তিনি কিন্তু সাপুড়ে নন, কিংবা সাপের খেলা দেখিয়ে পয়সাও রোজগার করেন না। তবু বঙ্গোপসাগর তীরে সাপের কথা উঠলে তার নামটাই আগে এলাকাবাসীর মাথায় আসে।
তারই কারণে বঙ্গোপসাগর তীরের লোকজন সাপ নিয়ে বেশ সচেতন। এখন আর জঙ্গল থেকে লোকালয়ে সাপের দেখা পেলে পিটিয়ে মারা হয় না। বরং তার ডাক পড়ে। তিনিও কাজ ফেলে ছুটে যান। খালি হাতে বিষধর সাপ ধরেন। পরে তা বনবিভাগের মাধ্যমে গভীর জঙ্গলে অবমুক্ত করেন। তারই লাগাতার প্রচারে সাপ ছোবল দিলে লোকজন ওঝার কাছে না গিয়ে ছুটছেন হাসপাতালে।
কথা হচ্ছিল জাকির মুন্সীকে নিয়ে। বঙ্গোপসাগর তীরের পাথরঘাটা উপজেলার রুহিতা গ্রামের এই বাসিন্দা ‘সাপের বন্ধু’ নামে পরিচিত। একবার সুন্দরবন থেকে ছুটে আসা বাঘ লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে 'টাইগার জাকির' হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পান।
অ্যানিম্যাল লাভার্স অব পাথরঘাটার টিম লিড আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, সাপ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির এই যাত্রায় জাকির নিজেও ছোবল খেয়েছেন। কিন্তু সাপের ছোবল থামাতে পারেনি তাকে। সাপ ধরার জন্য তিনটি জিনিস তাকে শেখানো হয়েছে। সাহস, কৌশল আর চোখের দৃষ্টিই সাপ ধরার মূল মন্ত্র। জাকির মুন্সি শুধু লাঠি দিয়েই সাপ ধরেন। সেটা যত বিষধর সাপই হোক। ধরার পর বাসায় নিয়ে পরিচর্যা করেন। শেষে বনবিভাগের উপস্থিতিতে গভীর জঙ্গলে অবমুক্ত করেন।
গরমের শুরু থেকে বর্ষাকাল-এই সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। জঙ্গলে পানি উঠলে লোকালয়ে বিশেষ করে মাঠে-ঘাটে, বাড়ির মেঝেতে, এমনকি বিছানাতেও লুকিয়ে থাকে সাপ। ফলে এই সময়টাতে প্রায়ই জাকির মুন্সিকে একাধিক জায়গায় ছুটতে হয় সাপ উদ্ধারের জন্য। তাতে অবশ্য আলস্য নেই তার। বরং এই কাজ করে তিনি খুশি।
সুন্দরবন থেকে যেভাবে লোকালয়ে সাপ
রুহিতা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বলেশ্বর নদী। নদীর বুকে জেগে উঠেছে বিহঙ্গ দ্বীপ আর হরিণঘাটা (লালদিয়ার চর)। চরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে জঙ্গল। তার পাশ ঘেঁষেই সুন্দরবন। সেখান থেকে জঙ্গল হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে সাপ। অজগর সাপের উপস্থিতি বেশি। মাঝে মধ্যেই দেখা মেলে বিষধর কালাজাত সাপ। বর্ষাকালে জঙ্গলে পানি উঠে গেলে তারা উঁচু আশ্রয়ের খোঁজে লোকালয়ে হাজির হয়।
রুহিতা গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন জাকির মুন্সি। গ্রামটি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। জঙ্গলের পাশে বেড়িবাঁধের ঢালে জাকিরের আবাস। প্রায় চার দশক আগে বেদেরা এসেছিল রুহিতা গ্রামে। তাদের কাছ থেকে সাপ ধরার কৌশল রপ্ত করেন জাকির। সেই থেকে যেকোনো সাপ খালি হাতেই ধরছেন জাকির।
সুন্দরবন থেকে স্রোতের কারণে লোকালয়ে চলে আসে অজগর। অজগর ঘরের আশপাশে থাকা হাঁস-মুরগি খেতে আসে। তখন আশপাশে মাছ ধরার জাল বিছিয়ে রাখায় তাতে আটকে যায়। অজগর মানুষের তেমন কোনো ক্ষতি করে না। স্বভাবের দিক থেকে অজগরের উল্টো চরিত্র কালাজাত সাপের। কালাজাত মানুষের কাছাকাছি থাকতে বেশি পছন্দ করে। বর্ষার বৃষ্টি হলেই ঘরে ঢুকে পরে। আশ্রয় নেয় বিছানা বা বালিশ কিংবা তোষকের নিচে।
'সাপবন্ধু' জাকির মুন্সির ভাষ্য
জাকির জানান, সাপ একটি ভীষণ ভিতু প্রাণী। তারা মূলত ভয় পেয়েই ছোবল মারে। সাপ ছোবল মারলে ‘অ্যান্টি ভেনাম’ দেওয়ার জন্য হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হবে। সে কথা এখন অনেকে বুঝতে পেরেছেন। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে সাপ নিয়ে সব মানুষদের সচেতন করার পাশাপাশি সাপ উদ্ধার করে চলেছেন জাকির মুন্সি। এখন মানুষের মধ্যেও এসেছে বিস্তর সচেতনতা।
জাকির মুন্সি বলেন, দিনে চলাচল না করলেও রাতে এরা ভীষণ ভয়ংকর। বেশিরভাগ সময় কালাজাত কামড়ানোর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। জ্বালা-যন্ত্রণা না থাকায় মানুষের মৃত্যু হয়। তিনি জানান, শুধু অজগরই উদ্ধার করেছেন অর্ধশতাধিক। এছাড়া আরও অনেক বিষধর সাপ ধরেছেন। সেগুলোকে লালদিয়ার চরে অবমুক্ত করেছেন।
স্ত্রী মাহিনুর বেগম সাপ ধরতে গেলে বাধা দেন না? জাকির মুন্সির সহাস্য জবাব, এক-আধবার জানতে চেয়েছিলাম, তুমি (মাহিনুর) কী গো ভয় পাও নাকি? স্ত্রীর উত্তর এসেছে, সমাজের জন্য কিছু করছ এটাই তো বড় কথা। তবে জাকির মুন্সির একটা আফসোস থেকে গিয়েছে। তিনি বলেন, সাপ ধরে বাসায় নিয়ে আসার পর তার প্রতি এক ধরনের মায়া জন্মায়। সাপের জন্য ইঁদুর, মাছ খাবার হিসেবে আনতে হত। যখন জঙ্গলে ছেড়ে দিতে যাই, তখন এক ধরনের ভালোবাসা সপের জন্য অনুভব করি। কেমন যেন মায়া পড়ে যায় সাপের ওপর!
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
পাথরঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, জাকির শুধু সাপ ধরে জঙ্গলে অবমুক্তই করেন না। লোকালয়ে ছুটে আসা যেকোনো বন্যপ্রাণী তিনি ফিরিয়ে দেন বনে। অনেক আগেকার কথা, সুন্দরবন থেকে একটি বাঘ ঢুকেছিল রহিতা গ্রামে। সেই বাঘটি সুন্দরবনের ফিরিয়ে দিতে জাকির সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই থেকে জাতির এলাকায় 'টাইগার জাকির' হিসেবে পরিচিত।
পাথরঘাটা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনের পাশের গ্রাম রুহিতা। সেখানে প্রায়ই অজগর ছুটে আসে। জাকির সেই অজগর উদ্ধার করে বনবিভাগের সহযোগিতায় বনে অবমুক্ত করেন। শুধু তাই নয়, আশপাশের গ্রামগুলোতে যখনই সাপের দেখা মেলে তখন আমরা জাকিরকে খবর দেই। জাকির সেই সাপ উদ্ধার করেন, আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন।
এইচকেআর
