আমতলীতে জেলেরা পাননি বরাদ্দের চাল


বৃহস্পতিবার রাইতে আর আজ শুক্রবার বেইন্যাকালে ভাত খাই নাই, পোলামাইয়া লইয়া না খাইয়া রইছি। আইজ বিষশইত বার দ্যার শ্যাড় চাউল আর দুইডা আলু ধার কইর্যা আনছি। হেইয়া রাইন্দা পোলা মাইয়া লইয়া দুহারে খামু। কথাগুলো বলছিলেন আর কাঁদ ছিলেন বৈঠাকাটা গ্রামের জেলে ইসমাইলের স্ত্রী শাহিদা বেগম।
বৃহস্পতিবার ইলিশ ধরায় ২২ দিনের অবরোধ চলাকালে সরেজমিন বৈঠাকাটা জেলে পল্লী ঘুরে দেখা গেছে তাদের কষ্ঠের জীবন আর অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটানোর চিত্র। মাছ ধরায় অবরোধ চলাকালের সরকারী সাহায্যের চাল পায়নি উপজেলার অধিকায়শ জেলেরা। চাল না পেয়ে তাদের জীবন যেন এখন ওষ্ঠাগত।
শাহিদা গেমের স্বামী ইসমাইল হাওলাদার বৈঠাকাটা গ্রামের একজন জেলে। ৩ ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ৫ জনের বড় অভাবী সংসার। তাঁর ওপরেও রয়েছে এনজিওর ঋণ। ৩টি এনজিওর নিকট থেকে ঋণ নিয়ে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা খরচ করে জাল নৌকা তৈরী করে পায়রা নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। মাছ পাওয়া গেলে কখনো সংসার চলে আর না পেলে না খেয়ে থাকতে হয়।
এ যেন নদীর ভাঙ্গা গড়ার মত জীবন। বড় ছেলে টাকার অভাবে কোরআনে হাফেজ হতে গিয়ে যেন থেমে গেছে পড়া। ছোট দুই ছেলেকে স্কুলেই দিতে পারেননি অভাবের তাড়নায়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টার সময় শাহিদার সাথে কথা হয় তার বাড়ীতে। এসময় তাঁর স্বামী ইসমাইল হাওলাদার বাড়ীতে ছিলেন না। কাজের সন্ধানে বেড়িয়েছেন কোথাও। শাহিদার বেগমের সাথে কথা বলার সময় তিনি জানান, মোরা জাইল্যা। মাছ ধইর্যা খাই।
নদীতে মাছ ধরাও বন্ধ। এহনো সরকারী চাউল পাই নাই। মাছ নাই টাহা নাই। মোরা এহন না খাইয়া আছি। কথাগুলো বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন, অশ্রুসজল নয়নে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, বুধবার রাইতে আর বৃহস্পতিবার ব্যাইন্যা কালে মোরা কেউ খাই নাই। এর আগের দিন দুহারে পানি দেওয়া সামান্য ভাত মরিচ দিয়া খাইছি।
তিনি আরো বলেন, মোগো দ্যাহার কেউ নাই। মোগো বাইচ্যা থাহার চাইয়া মইর্যা যাওয়াই ভালো।
একই পাড়ার আরেক জেলে শহীদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। মোগো আর কোন কামাই নাই। সরকারী চাউল এহনো পাইনাই। টাহার অভাবে আড বাজার বন্ধ। ঠিকমত তিন বেলা ভাত খাইতে পারি না। গত দুই বেলা ভাত খাই নাই। আইজ দুহারে ধার কইর্যা চাল ডাল আর আলু আনছি। হেই ডাল আর আলু সিদ্ধ করে খামু। ছোড একটা মাইয়া আছে হ্যারে দুধ কিন্যা খাওয়যাইতে পারি না। প্যাডের ক্ষিদায় খালি চিড়ায়। মাইডার কান্দা দ্যাখলে চোহে পানি আহে। কি করমু। যেহানে মোরা ঠিক মত তিন বেলা খাইতে পারি না হেহানে অর দুধ কিনমু কি দিয়া।
একই গ্রামের ষাটোর্ধ রফিক গাজীর সাথে কথা হয় তাঁর বাড়ীতে। এসময় তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ইলিশ ধরার জালা মেরামতের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। তাঁর ফাকে জানালের, বাবা বুড়া এই জীবনে অনেক কষ্ট। মাছ ধরা বন্ধ। সরকারী চাউল পাই নাই। জীবন বাঁচানোর জন্য কোন রকম ধার দেনা কইর্যা চলছি। সব জিনিষের দাম বেশী। কেনতে ব্যামালা টাহা লাগে। মোগোডে তো টাহা নাই। হেইয়ার পরও রইছে এনজিওর টাহার কিস্তি। জীবন আর চলে না। মনে চায় মইর্যা যাইতে।
কথা হয় জেলে পল্লীর জেলে, কালাম, খালেক, রিপন, মাইনুদ্দিন, রফিক আর জেলে পল্লীর নারী নাজমা, বিলকিছ ও রীমা বেগমের সাথে। সবার যেন একই কথা। মাছ ধরা বন্ধ কাম কাইজ নাই। কি খাইয়া বাচমু। সরকারী চাউল পাই নাই। হেইয়ার পর বাজারের সব জিনিষে আগুনের মত দাম। এহন মোগো মরা ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
আমতলী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হালিমা সর্দার বলেন, আমতলী উপজেলায় ৬হাজার ৭শ’ ৮৯ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। বৃহস্পতিবার আঠারগাছিয়া এবং গুলিশাখালী ইউনিয়নের জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে। শনিবারের মধ্যে সবাই চাল পাবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) এসএম সাদিক তানভির বলেন, চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে জেলেরা চাল পেয়ে যাবে।
এইচকেআর
