নিয়ম মানছে না পাড়া-মহল্লার দোকান


বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয় ও যানজট নিরসনে রাত ৮টার পর সব ধরনের দোকানপাট, শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতান, ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঘোষণার এক মাসের বেশি পেরিয়ে গেলেও শপিংমল, বিপণিবিতান ছাড়া এই নির্দেশনা মানছে না কেউ। পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ দোকান চলছে আগের নিয়মেই। শহরের কোনো কোনো খাবারের হোটেল খোলা থাকছে সারারাত। ফার্মেসি বন্ধের যে নির্দেশনা ছিল তাতেও ভাটা। বিষয়গুলো তদারকিতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে।
ব্যবসায়ীর দাবি, করোনার ধকল কাটিয়ে ব্যবসায় ফেরার পর এ ধরনের নিয়ম মানতে গেলে তাদের পথে বসতে হবে। তাই এ নির্দেশনা বাতিল চান তারা।
রাত ১২টা পর্যন্ত পাড়া-মহল্লার সাধারণ ওষুধের দোকান এবং রাত ২টার মধ্যে হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নিজস্ব ওষুধের দোকান বন্ধ প্রসঙ্গে দোকানিরা বলছেন, রাত ১২টা বা ২টার পর যদি কেউ অসুস্থ হন, তাহলে ওষুধ পাওয়া যাবে না। বিনা চিকিৎসায় রোগীরা মারা যাবেন।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহর পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এতে সাময়িক অসুবিধা হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক ফল রয়েছে। তাই তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। সবাইকে এই নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। অধিকাংশ দোকানি নিয়ম মানছেন। তাদের পক্ষ থেকে তদারকিও করা হচ্ছে। যেসব ফার্মেসি আবেদন করছে তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
তবে নির্দেশনা বাস্তবায়নে তদারকি নেই কেন, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত ২২ আগস্ট দেশের জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় একটি গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে বলা হয়, আগামী ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত থেকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকান বন্ধের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে ডিএসসিসি। এর মধ্যে সব দোকানপাট, শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাত ৮টার পর বন্ধ থাকবে। সব ধরনের খাবার হোটেল, রেস্তোঁরা, খাবারের দোকান খোলা থাকবে রাত ১০টা পর্যন্ত। খাবার সরবরাহ করা যাবে রাত ১১টা পর্যন্ত। এছাড়া চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহসহ চিত্তবিনোদনমূলক স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানগুলো রাত ১১টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। সাধারণ ওষুধের দোকান রাত ১২টা এবং হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নিজস্ব ওষুধের দোকান রাত ২টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন এলাকায় ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। সম্প্রতি ১৫ নম্বর ওয়ার্ড (ধানমন্ডি), ১৭ নম্বর ওয়ার্ড (কলাবাগান), ২৬ নম্বর ওয়ার্ড (আজিমপুর-লালবাগ), ২০ নম্বর ওয়ার্ড (শাহবাগ, সেগুনবাগিচা), ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড বংশাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাত ৮টার পরও সব ধরনের দোকানপাট খোলা। বিশেষ করে মুদি দোকান, খাবার হোটেল, চায়ের দোকানে বেচাকেনা চলছে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত।
বংশালের নাজিরাবাজারের খাবারের দোকানগুলো খোলা থাকছে ২৪ ঘণ্টা। এই এলাকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, রাত যত গভীর হয়, পুরান ঢাকার খাবার দোকানগুলোতে মানুষের ভিড় ততই বাড়ে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দলবেঁধে সেখানে খাবার খেতে যান। বিশেষ করে কাজী আলাউদ্দিন রোডে ভোর পর্যন্ত বিরিয়ানি, কাচ্চি বেচাকেনা চলে। এখন ডিএসসিসি রাত ১০টার সময় খাবার দোকান বন্ধের যে নিয়ম-কানুন চালু করছে, তা মানা খুবই কঠিন। এটা বাস্তবায়ন হলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) রাত ১০টা। পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে সরেজমিনে দেখা যায়, এই রোডেই পুরান ঢাকার বিখ্যাত হাজী বিরানি, হানিফ বিরানি, নান্না বিরানি, মদিনা বিরিয়ানি হাউজ, কাল কারিম জুস বার, বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর, মতি বিরয়ানি হাউজ, খুশবু বিরিয়ানি হাউজ, মামুন বিরিয়ানি হাউজ, মামা কাচ্চি অ্যান্ড কাবাব ঘর, বোখারি রেস্তোঁরা। প্রতিটি দোকানে ভিড়। খাবার সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন দোকানিরা। এছাড়া বংশাল মোড়ের বনলতা সুইটস অ্যান্ড বেকারি, আল-নাসির সুইটস অ্যান্ড বেকারি, আল সিরাজ ফুলক্রিম সুইটস খোলা দেখা যায়।
রাত ১০টার আগে বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে নাজিরাবাজার চৌরাস্তায় মামা কাচ্চি অ্যান্ড কাবাব ঘরের মালিক মো. ইমরান বলেন, আমাদের এখানে তিনটা পর্যন্ত সব খোলা, কেউ নিয়ম মানে না। যখন আসেন খোলা পাবেন। কেউ খালি হাতে বা না খেয়ে ফিরে যাবে না।
একইভাবে কলাবাগানে ডলফিন গলিতে সবুজ মুদি ভান্ডারসহ আরও ১০ থেকে ১২টি দোকান দেখা যায় খোলা। মুদি দোকানি সবুজ বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা মেনে ব্যবসা করলে সংসার চলবে না। মহল্লার দোকানপাট এমনিতেই রাত ১১টা থেকে ১২টার পর বন্ধ হয়ে যায়।
তবে গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, পল্টন, শান্তিনগর, বেইলি রোড, নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি এলাকার অধিকাংশ শপিংমল বা বিপণিবিতান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বন্ধ করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে গুলিস্তানে ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণের অধিকাংশ বিপণিবিতান যথাসময়েই বন্ধ হচ্ছে। এ নিয়ে তেমন কারও আপত্তি নেই। তবে কিছু ব্যবসায়ীর দাবি, তারা করোনায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আরও এক-দুই ঘণ্টা দোকান খোলা রাখা গেলে ব্যবসা ভালো চলতো।
ফার্মেসি
গত ১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার মধ্যে সাধারণ ওষুধের দোকান এবং রাত ২টার মধ্যে হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নিজস্ব ওষুধের দোকান বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ডিএসসিসির এমন নির্দেশনার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে সব মহল থেকে। বিশেষ করে ফার্মেসি বন্ধ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
সমালোচনার মুখে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি ডিএসসিসির নির্দেশনা নাকচ করে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা যাবে বলে জানান। কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যের পরও নিজেদের বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করেনি ডিএসসিসি। তবে ১ সেপ্টেম্বর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সংলগ্ন ডি এস ফার্মেসি, অপু এন্টারপ্রাইজ ও খান জাহান আলী ফার্মেসিকে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার অনুমোদন দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
ঢাকা মেডিকেল মেডিসিন মার্কেট মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি লুৎফর রহমান খান বলেন, ডিএসসিসি শর্তসাপেক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন তিনটি ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার অনুমোদন পেয়েছে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন ফার্মেসি আছে অর্ধশতাধিক। বাকিরা নির্ধারিত সময়েই দোকান বন্ধ করছেন। কেউ কেউ হয়তো আরও বেশি রাত পর্যন্ত খোলা রাখছেন।
এসব বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ঢাকা মহানগরীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে সবাই সাড়া দিয়েছেন। তারপরও রুটিন করে আমরা তদারকি করছি। পাড়া-মহল্লার কিছু দোকান ছাড়া সবাই নিয়ম মানছেন।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল সংলগ্ন ফার্মেসি খোলা রাখতে অনেকেই আবেদন করেছেন। তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে অনেককেই ২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি খোলা রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এভাবে যারা যথাযথভাবে আবেদন করবেন, আমরা তাদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয়তা অনুসারে অনুমোদন দেবো।
এইচকেআর
