ঢাকা বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

Motobad news

চড়ামূল্যে ভোলার ৩ কূপ খননের কাজ পেতে গ্যাজপ্রমের মিথ্যা তথ্য 

চড়ামূল্যে ভোলার ৩ কূপ খননের কাজ পেতে গ্যাজপ্রমের মিথ্যা তথ্য 
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে সাশ্রয়ী মূল্যে তিনটি কূপ খননের কাজ দেওয়ার সারসংক্ষেপে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আগের বহুল বিতর্কিত দরের চেয়েও রেকর্ডমূল্যে ভোলায় ৩টি কূপ খননের কাজ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।

রাশিয়ান ওই কোম্পানিটিকে উচ্চমূল্যে কাজ দেওয়া নিয়ে বরাবরেই কঠোর সমালোচনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স যে কূপ ৩০ থেকে ৫৫ কোটি টাকায় খনন করতে পারে, একই কাজে তাদের দু’শ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। গ্যাজপ্রমকে এখন পর্যন্ত কয়েক ধাপে ১৭টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে। এগুলোর্ একেকটির বিপরীতে ১৪ থেকে ১৭.৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়।

আর ভোলায় প্রস্তাবিত নতুন তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রম প্রস্তাব দিয়েছে ৬৩ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার (প্রতিটি ২১.৫ মিলিয়ন ডলার)। দু’একজন কর্মকর্তা এতে আপত্তি তোলার চেষ্টা করলেও প্রভাবশালীদের চাপে নিবর হয়ে গেছেন। পেট্রোবাংলার একজন অতিউৎসাহী কর্মকর্তার চাপের কারণে সায় দিতে বাধ্য হন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে এটি ওপর থেকে আদেশ এসেছে। ফাইলে সই না দিলে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত গ্যাজপ্রমের সেই প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। যা শিগগিরই ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উঠতে যাচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, আগের কূপগুলোর চেয়ে এবারের তিনটি কূপের গভীরতাও কম। স্বাভাবিকভাবেই এবার দর কমে যাওয়ার কথা। উল্টো বেশি হওয়াটা খুবই বিস্ময়কর। গ্যাজপ্রম শাহবাজপুর কূপ#৩ ও কূপ#৪ খনন করেছে। এগুলোর গভীরতা ছিল ৪ হাজার মিটার (এমডি)। আর প্রস্তাবিত তিনটি কূপের গভীরতা হবে প্লাস-মাইনাস ৩৪৫০মিটার। প্রায় ৫০০ মিটার গভীরতা কমলেও দর বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। প্লাস-মাইনাস ৩৪৫০ মিটার গভীরতায় শাহবাজপুর ইস্ট ও ভোলা নর্থ কূপ খননে প্রতিটির জন্য পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে ১৫.৮ মিলিয়ন ডলার। তখনকার সেই দরেই চরম সমালোচিত হয়েছে। বাপেক্স নিজে করলে এর অধের্কের কম খরচে এই কূপ খনন করতে পারে।

গ্যাজপ্রম দর বাড়াতে গিয়ে পুরোপুরি জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও পেট্রোবাংলার সেই কর্তারা চোখ বুজে বসে রয়েছেন। ঠিক যেনো কতো বেশি দরে তিনি কাজ দিতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। গ্যাজপ্রমের রিগ ভোলাতে থাকলেও তারা রিগ মোবিলাইজেশনের জন্য ৪ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার বিল প্রস্তাব করেছে। ২০১৭ সালে ভোলা নর্থ কূপ খনন করার পর বাপেক্সের ইয়ার্ডে রিগ রেখে দেয় গ্যাজপ্রম। রিগটি সরিয়ে না নেওয়া বাপেক্সের পক্ষ থেকে ইয়ার্ড ভাড়া দাবি করে চিঠি দেওয়া হয় রাশিয়ান ওই কোম্পানিকে। রিগটি আজ পর্যন্ত গ্যাজপ্রম সরিয়েও নেননি, আবার ভাড়াও দেননি। বিষয়টি বাপেক্স, পেট্রোবাংলা ও মন্ত্রণালয়ের সকলেই জানলেও রিগ মোবিলাইজেশনের জন্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে উসখুশ করছে। আর চড়া মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স।

আবার স্থান নির্বাচন নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। বলা হচ্ছে, যেগুলো এখন খনন করা অনেকটাই অনর্থক। অর্থাৎ গ্যাস পেলেও তা পাইপ লাইনে নেওয়া সুযোগ নেই। ভোলা গ্যাস ফিল্ডে ৪টি কূপ থেকে দৈনিক ৮০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ থাকলেও চাহিদা না থাকায় ৪০ থেকে ৫০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। আরও ২টি কূপ (টাগবি ও ভোলা নর্থ) রেডি হয়ে বসে আছে। টাগবি ২০১৭ এবং ভোলা নর্থ ২০১৮ সাল খনন করা হয়। অর্থাৎ ৩ বছর আগেই আরও বেশি গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে শাহবাজপুর (ভোলা) গ্যাস ফিল্ড। চাহিদা থাকলে এখনই ১২০ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলনে সক্ষম। চাহিদা না থাকায় গ্যাস তুলতে পারছে না বাপেক্স। একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে তাতে ৪০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাহিদা তৈরি হবে। তারপরও ২০ এমএমসিএফডি গ্যাস থাকবে উদ্বৃত্ত। চড়ামূল্যে অগ্রিম বিনিয়োগ করে রিটার্ন না আসায় সংকটে পড়ছে বাপেক্স। তারা নিজেদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে টাকা নিয়ে দায়গ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

গ্যাজপ্রমের প্রস্তাবিত তিনটি কূপের মধ্যে দুটি অনুসন্ধান ও একটি মূল্যায়নসহ উন্নয়ন কুপ (এপ্রেইজাল কাম ডেভেলপমেন্ট)। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় গ্যাজপ্রমকে এ কাজ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ পাঠায় তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, গ্যাজপ্রম ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’ এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন।

এতে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কিছু কর্মকর্তার অতিউৎসাহী ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্তার দৌড়ঝাঁপ বেশ দৃষ্টিকটুভাবেই দৃশ্যমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম  বলেন, ১৯৯৬ সালে ভোলা আবিষ্কার করলো বাপেক্স, ২০১৮ সালে সেখানে আরেকটি ফিল্ড আবিষ্কার করেছে, বাপেক্স মনে করছে সাউথে যাবে। আমরা বাপেক্সকে থামিয়ে দিয়ে গ্যাজপ্রমকে নিয়ে আসলাম। এর মতো আত্মঘাতী আর কোনো বিষয় হতে পারে না। দেশীয় কোম্পানি প্রথম ধাপে সফল, দ্বিতীয় ধাপেও সফল, তৃতীয়ধাপে কাজ করতে চাইল আমরা দিলাম না।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যক্তিদের লাভ-লস হিসেবে করে কাজ দেওয়া হয়েছিল, এখানে তেমনি হয়েছে। এখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আইয়ুব খান চৌধুরী  বলেন, আমি সমালোচনার কোনো কারণ দেখি না। গ্যাসের রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বেশি দরে কাজ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।

গ্যাজপ্রমের রিগ ফিল্ডে থাকার পরও মোবিলাইজেশন ফান্ড দেওয়া যৌক্তিকতা কি এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারবো না। আপনি বাপেক্সের এমডির সঙ্গে কথা বলেন।

বাপেক্স এমডি মোহাম্মদ আলীকে ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি। পরে এসএমএস দিয়েও সাড়া মেলেনি।

বাপেক্সের সাবেক এমডি মুতর্জা আহমেদ ফারুক এক সেমিনারে বলেছেন, বাপেক্স নিজস্ব সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করতে পারেন না। বরং জ্বালানি বিভাগ থেকে এবং পেট্রোবাংলা থেকে তাদের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সেখানে কিন্তু প্রোপার টেকনিক্যাল লোক নেই। প্রোপার লোককে প্রোপার জায়গায় বসানো উচিত। মূল বিষয় হচ্ছে সরকারকে চাইতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের আরও স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি।

এখন পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্যাসের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে সিলেট অঞ্চলের পরে ভোলায় বড় গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে। যেখানে কূপ খনন করা হচ্ছে সেখানেই গ্যাসের সন্ধান মিলছে। ধারণা করা হচ্ছে এই গ্যাসের স্তর সাগর এবং বিচ্ছিন্ন দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলটিকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে, এখনও বিদ্যমান। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা কেউ টাকার কাছে কেউ প্রমোশনের লোভে, আবার কেউ চোখ রাঙানির কাছে আত্মসমর্পণ করেন।


টিএইচএ/
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন