বরিশালে রাতের আঁধারে পৌঁছে যাচ্ছে খাদ্য সহায়তা


করোনা মহামারি শুরুর পর বরিশাল নগরীর কাশিপুর বিল্লু বাড়ি এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধা মুকুল বেগমের সংসারে নেমে আসে নতুন এক অন্ধকার। উপার্জন কমে যেতে থাকলে পরিবারে দেখা দেয় অভাব অনটন। আর কয়েকদিন ধরে দেখা দেয় খাদ্য সংকট। সংকটকালীন এ পরিস্থিতিতে অন্যের কাছ থেকে শুনে নিজেদের মোবাইল দিয়ে লতা কল দেন ৩৩৩ নম্বরে।
২-৩ দিন আগে দেওয়া এই কলটির মাধ্যমে তারা খাদ্য সহায়তা চাইলে বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে করোনাকালীন ঈদ উপহার নিয়ে হাজির হন লতাদের বাড়িতে। যেখানে লতাদের অবস্থা দেখে, ঝুপড়ি ওই ঘরটিতে দাঁড়িয়েই তাদের সার্বিক বিষয়ে জানতে চান বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান।
এ সময় লতা ও তার মা মুকুল বেগমের বর্ণনায় বেড়িয়ে আসে তাদের তিন নারীর দারিদ্রতার কথা। সঙ্গে সঙ্গে মো. মুনিবুর রহমান তাদের বসবাসের জন্য বিনামূল্যে একটি ঘর দেওয়ার কথা জানান। মুহূর্তেই জ্বলে ভেজা ছল-ছল চোখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পরেন মা মুকুল বেগম ও তার দুই মেয়ে।
বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান জানান, বরাদ্দ পাওয়ার পরপরই আমরা ৩৩৩ নম্বরে কল করে যারা খাদ্য সহায়তা চেয়েছেন তাদের বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে করোনাকালীন ঈদ উপহার নিয়ে হাজির হচ্ছি। যে উপহারের প্যাকেটে চালসহ বিভিন্ন ধরণের খাদ্যসামগ্রী রয়েছে। এই ধারাবাহিকাতয় বৃহস্পতিবার রাতেও আমরা সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতে সাহায্যের আবেদনকারীদের বাড়িতে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে শুরু করি। মূল সড়কে গাড়ি রেখে মাটির পথ ধরে অন্ধকারে অনেকটা পথ পায়ে হেটে বিল্লুবাড়ি এলাকায় লতাদের বাড়িতে যাই।
সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তারা যে জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরটিতে রয়েছেন সেটি তাদের নয়। দরিদ্র হওয়ায় জমির মালিক বিনাভাড়ায় তাদের সেখানে থাকতে দিয়েছেন। আর লতা তার ছোট বোন এবং মাকে নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। তাদের ঘরে কোন পুরুষ মানুষ নেই।
লতা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান কিন্তু করোনার কারণে সে কাজে ভাটা পড়ায় খাবারের সংকট দেখা দিলে ৩৩৩ নম্বর ফোন দেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, তাদের বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে নির্মাণাধীন ঘরের একটি দেওয়ার কথা বলি। এতে তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, তাদের যতদ্রুত সম্ভব ছবি, ভোটার কার্ডের কপি ও দরখাস্ত নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসতে বলেছি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আশাকরি ১৫-২০ দিনের মধ্যে নতুন ঘর পাবেন তারা । লতা বলেন, ‘৩৩৩ নম্বরে ফোন দিছি ভয়ে ভয়ে? দেওয়ার পরও ভাবতে ছেলাম কিছুই পামুনা মোনে হয়। কিন্তু সন্ধ্যায় যহন ছারেরা ফোন দিয়ে বাড়ির ঠিহানা জিগাইলো, তহন বুজঝি কিছু একটা পামু। তাই রাস্তার মাথায় গিয়্যা দাঁড়াইয়া আছেলাম।
সারেরা যে ঘর তামাইত আইবে, হ্যা তো বোঝতেই পারিনাই। ঘরে আইয়া যহন আমাগো লগে কতা কইয়্যা বিভিন্ন জিনিস জানলো। তহন হঠাৎ একজন ছার বিনা পয়সায় ঘর দেওয়ার কতা কইলো। এত খুশির খবর মোগো লইগ্যা। ’ লতার মা মুকুল বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘বড় অভাবের মধ্যে দিন কাডাইতে আছেলাম। সারেরা যে খাওনের প্যাকেট লইয়্যা আইছে, হেইডাই অনেক কিছু, এতেই মোরা অনেক খুশি হইছি। আর এহন তো সরকার মোগো বিনা টাহায় জায়গা-ঘর দেবে বোলে। ভাইগ্যে থাকলে পামু, তয় পাওন লাগবো না, যে ছারে মোগো এ কথা খালি কইছে হ্যারে জন্য দোআ হরি। আল্লায় য্যান হ্যারে ভালো রাহে।
’ লতার ছোট বোন তারা বলেন, ‘জীবনে ভাবতেও পারি নাই খাওন লইয়্যা অফিসারের মতো মানুগুলো মোগো ঘরে আইবে। যেহানেই ঘর দেবে হ্যাহানে গিয়া মোরা থাকতে পারমু। এদিকে একই কাশিপুরের তীলক এলাকার বাসিন্দা ওয়াকশপশ্রমিক মো. নাছির উদ্দীনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার হেনা ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তার আবেদন জানান ।
তিন শিশু কন্যা সন্তানের এ জননী বলেন, স্বামী নাছির উদ্দীন ঢাকায় ওয়াকশপে কাজ করতেন, তবে করোনার কারণে তার কাজ নেই তাই বাড়িতেই থাকেন। তিন মেয়ে ও তারা দু’জন মিলে খুব কষ্টে টিনের জরাজীর্ণ ঘরটিতে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছেন। নাসরিন বলেন, দু’দিন আগে সেহেরি খেয়ে ওযু করতে ঘরের পাশের পুকুরে যাই।
ঘরে খাবারের সংকটের কারণে চিন্তা করি ৩৩৩ নম্বরে একটা কল দেই। এরপর ঘরে গিয়ে বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলে সাহস করে ৩৩৩ নম্বরে ফোন দেই এবং আমাদের বর্তমান অবস্থা জানাই। কিন্তু ভাবিনি খাদ্য সহায়তা পাবো আর তাও বাড়িতে বসে। সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে স্যারেরা বাসার ঠিকানা নেয় এরপর রাতের বেলা ঘর পর্যন্ত সহায়তার প্যাকেটটি পৌঁছে দিয়ে গেছে।
অন্যদিকে বরিশাল সদর উপজেলার কলসগ্রামের বাসিন্দা পঙ্গু মো. আলমগীরের ঘরেও রাতের বেলা খাদ্য সহায়তা নিয়ে হাজির হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন একটি দল। খাদ্য সহায়তা পেয়ে নির্মাণশ্রমিক মো. আলমগীর বলেন, টিউমারের কারণে ৮/১০ বছর আগে তার ডান পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়, এরপর থেকে তিনি পঙ্গু হলেও কষ্ট করে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন। তবে বর্তমানে কোনো কাজ নেই তার হাতে। মা, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাইয়ের ঘরটিতে থাকছেন ঠিকই তবে আর্থিক কারণে নানা সংকটে পড়েছেন।
তাই তিনি বেশ কিছুদিন আগে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চান। কয়েকদিন হয়ে যাওয়ার কারণে বুঝছি পাবো না, কিন্তু বৃহস্পতিবার (৬ মে) রাতে খোদ ইউএনও স্যার বাড়িতে একটি উপহারের প্যাকেট নিয়ে এসে হাজির। বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সহায়তার জন্য যারা আবেদন জানিয়েছেন বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে তাদের কাছে পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়েছে।
তবে এখন থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সহায়তাগুলো আবেদনকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা ১০ জনের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছি, যারা ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়েছিলেন। রাতের বেলা মানুষের বাড়ি খুঁজে খুঁজে এভাবে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে পেরে বেশ ভালো লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, যাদের বাড়িতে যাচ্ছি, তারা প্রথমে আমাদের দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, এভাবে সেবা পাবে। তাদের আনন্দের হাসি বা অশ্রু আমাদের কাজে আরও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
এ কাজের সঙ্গে সহায়তা করছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান, উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সন্যামত, উপ-সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম, পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা বাবুল গাজী, সহকারী প্রোগ্রামার চৌধুরী শওকত হোসেনসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আনসার সদস্যরা।
এইচকেআর
