‘শেষবারের মতো ছেলেটার মুখ আমি দেখতে পারিনি’


বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া একটি ট্রলারে জলদস্যুদের হামলায় জীবন বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হওয়া ৯ জেলের মধ্যে পাঁচ জেলের এখনো সন্ধান মেলেনি। আট দিনেও তাঁদের সন্ধান না পাওয়ায় আহাজারি চলছে এসব জেলে পরিবারে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা নিখোঁজ হওয়ায় গভীর অনিশ্চয়তা তাড়া করছে পরিবারগুলোতে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের চরকগাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা কাইউমের আয়ে চলতো ছয় সদস্যের সংসার। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হামলার নিখোঁজ ৯ জেলের মধ্যে কাইউম একজন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কাইউমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে ১৫ থেকে ২০ জন স্বজন। তাঁদের সবার চোখে হতাশার ছাপ। নিখোঁজ কাইউমের স্ত্রী ফজিলা বেগম এক সপ্তাহ ধরে মুখে দানাপানি দিচ্ছেন না। দিন-রাত শুধু কাঁদছেন। বিলাপ করতে করতে ফজিলা বেগম বলেন, ‘তোমাগো ধারে মুই, মোর পোলাপান আজীবন গোলাম থাকমু, খালি মোর স্বামীরে একটু আইন্না দেও।’ মায়ের আজাহারি দেখে কাইয়ুমের ছোট ছোট তিনটি ছেলে-মেয়েও কাঁদছিল।
একদিকে নিখোঁজ স্বামীর জন্য দম আটকানো আর্তনাদ, আরেকদিকে সংসার, ছোট ছোট ছেলে–মেয়েদের কী হবে—এ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা ফজিলা বেগমকে আরও বিচলিত করে তুলেছে। ফজিলা বেগম কান্না থামিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেন, তাঁকে ট্রলার থেকে ফোন করেছিলেন তাঁর স্বামী। বলেছিলেন সাগরযাত্রার কথা এবং সবাইকে নিয়ে সাবধানে থাকার কথা। বলেছিলেন তাঁর (কাইউম) জন্য দুশ্চিন্তা না করার কথা। এক সপ্তাহ পরে ফিরে আসার কথা বলেছিলেন কাইউম। এই-ই ছিল শেষ কথা। এরপর যতবার ফোন দিয়েছেন আর পাননি।
একই ইউনিয়নের রায়ভোগ এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম এই পাঁচ নিখোঁজ জেলের একজন। কালামের ছেলে আবদুর রহিম বলেন, ‘ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে গত শুক্রবার রাতে। আমরা শনিবার বিকেলে এই ঘটনা জানতে পারি। ঘটনার পর থেকেই বাবা নিখোঁজ। বাবার সন্ধানের আমরা দুটি মাছ ধরার ট্রলার পাঠিয়েছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করে, না পেয়ে তারা ফিরে এসেছে। এর আগে আর কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। এটাই আমাদের সঙ্গে প্রথম।’
ওই ইউনিয়নের পূর্ব চরকগাছিয়া গ্রামের নিখোঁজ খায়রুলের ইসলামের মা হাসিনা বেগম ছেলেকে ফিরে পেতে আর্তনাদ করছেন। সাগরে যাওয়ার সময় খায়রুল তাঁর মাকে ফোন করে বলছিলেন ‘মা আমরা রওনা দিছি।’ হাসিনা বেগম জবাবে বলেছিলেন, ‘এই অবেলায় কোথায় যাও’। খায়রুল বলেছিল, ‘ট্রলারের মাঝি এখনি যাবে যে, মা।’ তখন ছেলেকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য বলেছিলেন মা। কিন্তু ছেলে আসেনি। ‘শেষবারের মতো ছেলেটার মুখ আমি দেখতে পারিনি’—বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসিনা বেগম।
বরগুনা সদরের নলী বন্দরের চরগাছিয়া এলাকার মনির হোসেনের মালিকানাধীন এফবি ভাই ভাই নামের ট্রলারটি ১৮ জেলেকে নিয়ে গত শুক্রবার দুপুরে পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্য বন্দর থেকে বরফ, জ্বালানি ও বাজার-সওদা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার উদ্দেশে যায়। ট্রলারটি পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের সাগরে পৌঁছালে রাত দেড়টার দিকে অন্য একটি ট্রলার নিয়ে জলদস্যুরা ওই ট্রলারে হামলা চালায়। এ সময় দস্যু দলের সদস্যরা ট্রলারের সব জেলেকে মারধর শুরু করে।
একপর্যায়ে দস্যুরা জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ফাঁকা গুলিবর্ষণ করলে আতঙ্কে ৯ জেলে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ডাকাতেরা ট্রলারটিতে লুটপাটের পর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেলে ট্রলারটি সাগরে ভাসতে থাকে। পরে রোববার সকালে অন্য জেলেরা অপর একটি ট্রলারের সাহায্যে ট্রলারটিতে অবস্থানকারী আহত ৯ জেলেকে তীরে ফিরিয়ে আনেন। নিখোঁজ হন বাকি ৯ জেলে।
ওই ৯ জেলের মধ্যে চারজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। উদ্ধার ওই জেলেদের মধ্যে আবদুল হাই (৫০) নামের এক জেলে পাথরঘাটা হাসপাতালে আনার পর মারা যান। বাকি পাঁচ জেলের এখনো সন্ধান মেলেনি। তাঁরা হলেন কাইউম জমাদ্দার (৩৫), আবুল কালাম (৫৮), খায়রুল ইসলাম (৪০), আবদুল আলীম (৫৫) ও ফরিদ মিয়া (৩৮)। তাঁদের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের চরগাছিয়া গ্রামে।
সাগরে এই দস্যুতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে অভিযান চালিয়ে চার জলদস্যুকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। মঙ্গলবার রাতে উপজেলার গন্ডামারা, বড়ঘোনা, বাংলাবাজার, শীলকূপে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই চার জলদস্যুকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনার মো. কাইছার (২৫), মো. সেলিম (৪০), মো. ইকবাল হোসেন (১৫) ও পূর্ব বড়ঘোনার মো. জাহিদ (২৫)। অভিযানে চারটি দেশীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, দুটি হাতুড়ি, তিনটি দা, একটি কিরিচ, দুটি শাবল, জাল ও তাঁদের ব্যবহৃত নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব-৭-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মো. নুরুল আবছার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জলদস্যুতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। গত বুধবার ওই চারজনকে বাঁশখালী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। সাগরে ডাকাতির ঘটনায় অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এইচকেআর
