ঢাকা বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

Motobad news

বরগুনায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে অপচিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, থানায় জিডি

বরগুনায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে অপচিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, থানায় জিডি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

“আমারে ছাড়েন, আমি আর ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। কে কোথায় আছেন, আমারে বাঁচান” পুতুলের এমন গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিলো বরগুনা সদরের কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু তার এই আত্মচিৎকার মন গলাতে পারেনি চিকিৎসকদের। দীর্ঘসময় আটকে রাখার পর উন্নত চিকিৎসার নামে তড়িঘড়ি করে বরিশালে পাঠালেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তানজিলা আক্তার পুতুল (২৮) নামের ওই প্রসূতি গৃহবধূ।

মৃত পুতুল বরগুনা সদর উপজেলার ২ নম্বর গৌরিচন্না ইউনিয়নের গৌরিচন্না গ্রামের শহিদুল ইসলামের স্ত্রী। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজারিয়ানের পরে বরিশালে পাঠানো হয় ওই গৃহবধূকে।

পরিবারের অভিযোগ চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলার কারণে মৃত্যুবরণ করেছে পুতুল। এমন অভিযোগ এনে বরগুনা সদর থানায় একটি সাধার ডায়েরীও করেছে মৃত গৃহবধূর পরিবার। ডায়েরী নম্বর ১১০৭।

তবে ঘটনার পর পরই কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পুলিশ এবং স্থাস্থ্য বিভাগ বলছে তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পুতুলের মা পারভীন বেগম জানান, গত ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার বেলা ১২টার দিকে তার প্রসূতি মেয়েকে সিজারিয়ানের জন্য কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওইদিন দুপুর ২টায় অস্ত্রপচারের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার কিছুক্ষণ পর পুতুলের আহাজারি শুনতে পান তারা।

মৃত পুতুলের খালা বলেন, ‘ডাক্তার সাফিয়া পারভীন ও ডাক্তার মুনতাহা মারিয়ম পুতুলের অপারেশন করেন। ডাক্তার ও নার্সরা পুতুলের আত্মচিৎকারের পরও হাসপাতালের চতুর্থ তলায় একটি কক্ষে আটকে রাখেন।’

পুতুলের স্বজনরা জানান, অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর ‘আমারে বাঁচাও, আমারে ছাঁড়ো’ বলে চিৎকার করার পর তারা অপারেশন থিয়েটারের সামনে ছুটে যান। কিন্তু মুহুর্তেই আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এরপরে দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরেও পুতুলের সঠিক কোন তথ্য না জানতে পারায় মৃত পুতুলের স্বজনরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা দ্রুত সটকে পরেন।

অজ্ঞান অবস্থায় তানজিলা আক্তার পুতুলকে প্রথমে বরগুনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন।

এলাকাবাসী জানায়, কোন সেবিকা ছাড়াই কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের ম্যানেজার মন্টু রোগীকে সাথে নিয়ে রাতে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেন। এসময় তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘রোগী সুস্থ আছেন, কোন নার্স লাগবে না।’ রোগীর মৃত্যুর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং উল্টো স্বজনদের ওপর চড়াও হন।

কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের অনিয়ম আর ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নতুন নয় বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দা এবং ভুক্তভোগীদের। বিগত পাঁচ বছরে এমন অসংখ্য ঘটনার অনুঘটক এই হাসপাতালটি।

এখানে নবজাতক আটকে রেখে টাকা আদায়, বিক্রি করে দেয়া এবং প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে একাধিক। কিন্তু একটি ঘটনায়ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ।

প্রতিবারই ঘটনার দায় এড়াতে রোগীর স্বজন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ঘটনা ধামাচাপা দেন। এমনকি পুতুলের মৃত্যুর ঘটনা একই পন্থা বেছে নেন তারা। ঘটনার দায় এড়াতে রোগীর স্বজন এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে বাকবিতণ্ডা ও একপর্যায় ম্যানেজের বিষয়টি উঠে আসে এলাকাবাসীর মুখে।

তবে পুতুলের এমন মৃত্যুর ঘটনায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ও ডাক্তারদের বিচার দাবি করছেন নিহত স্বজন এবং এলাকাবাসী।

এদিকে, বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবৈধভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ক্লিনিক স্থাপনে সরকার বা স্থাস্থ্য বিভাগের বৈধকোন কাগজপত্র নেই প্রতিষ্ঠানটির। অবৈধ ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য বিভাগের দফায় দফায় অভিযানের পরেও বহাল তবিয়তে চলে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। রহস্যজনক কারণে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ।

বরগুনা জেলা নাগরিক সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘এই বেসরকারি কুয়েত প্রবাসী হাসপাতাল একের পর এক এমন অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নীরবতা এমন ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।’

বরগুনার জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ফজলুল হক কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বৈধ কাগজপত্র না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘রোগী মৃত্যুর বিষয়টি অবগত হওয়ার পরই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি। মৃত পুতুলের বাচ্চার প্রাথমিক অবস্থা আমরা দেখেছি। বরিশাল মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পুতুলের মৃত্যুরজন্য কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের ডাক্তারদের গাফেলতি বা ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।'

এদিকে, অভিযোগ প্রসঙ্গে কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরেজমিনে কুয়েত প্রবাসী হাসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রধান ফটকে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটনার পর থেকেই হাসপাতালটি বন্ধ রাখা হয়েছে।

বরগুনা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ আলী আহমেদ বলেন, ‘তানজিলা আক্তার পুতুলের অপচিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে মর্মে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী হয়েছে। আমরা অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। অভিযোগের সত্যা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


সংবাদদাতা
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন