শুভ জন্মদিন ‘ইবনে বতুতা’


ইবনে বতুতার নাম শোনেনি এমন লোক হয়তো খুব কমই আছে। ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন পর্যটকের মধ্যে ইবনে বতুতার নাম থাকবে তালিকার প্রথম দিকেই, যিনি ঘুরে বেরিয়েছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পদধূলি ফেলেছেন দেশ-দেশান্তরে।
ইবনে বতুতা নামে তিনি পরিচিত হলেও তার মূল নাম শেখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ। তিনি একাধারে একজন পর্যটক, বিচারক, চিন্তাবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক। আজ এই ভ্রমণ সাধকের জন্মদিন। তিনি ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তানজিয়েরে জন্মগ্রহণ করেন।
ইবনে বতুতা ২০ বছর বয়সে বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। এরপর একটানা ৩০ বছর ঘুরে বেড়ান বিশ্বের নানা প্রান্ত। এ সময় তিনি ভ্রমণ করেন ১ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। তৎকালে তিনি পৃথিবীর সব মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন এবং সেসব অঞ্চলের শাসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এই দীর্ঘ পথ ভ্রমণের পর ইবনে বতুতা যখন তার নিজ দেশ মরক্কোতে ফিরে আসেন, তখন মরক্কো সুলতান আবু ইনান ফারিস ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য তাকে তাগাদা দেন। তার সমগ্র ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য সাহায্যকারী হিসেবে কবি ইবনে জোযাইয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৩৫৫ সালে তার ভ্রমণকাহিনী নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়।
তার এই ভ্রমণকাহিনীর নিবন্ধটির নাম রাখা হয় ‘রিহলা’। এটি ছিল ১৪ শতকের পূর্বে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক দলিল। এই গ্রন্থটি ১৯৫৮ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় এবং তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে।
ইবনে বতুতার ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে বের হয়ে আসে ঐ সমস্ত অঞ্চলের তৎকালীন মানুষের জীবনযাপন, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থা। একইভাবে তার বিবরণ থেকেই আমরা জানতে পারি সে সময়ে বাংলার অধিবাসীদের জীবন ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে।
তার ভ্রমণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি সর্বসাধারণের পর্যায়ে মিশে যেতেন। সব ধরনের মানুষের সাথে কথা বলতেন। আর এসমস্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধকরে রাখতেন। তার বর্ণনায় প্রকাশ পেত সেসমস্ত অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও নয়নাভিরাম প্রকৃতিক সৌন্দর্য। প্রাণবন্ত অনুভূতি, সূক্ষ্ম হৃদয়াবেগ এবং তার সাবলীল ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী সেই সময়কার বাস্তব চিত্রটাই যেন তুলে ধরেছে।
ইবনে বতুতা জন্মগ্রহণ করেন মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে। এক সম্ভ্রান্ত সুন্নি মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন কাজী। ধারণা করা হয়, তার পরিবার পশ্চিম আফ্রিকার ‘লাওয়াতা’ যাযাবর শ্রেণির উত্তরসূরী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাপক পান্ডিত্য অর্জন করেন। এছাড়া তাঞ্জিয়ার আইনশাস্ত্র এবং সাহিত্যে উপর জ্ঞান অর্জন করেন।
তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় পরিব্রাজক হওয়া। মিশর, সিরিয়া ও হিজাজ অঞ্চলের খ্যাতনামা আলেমদের অধীনে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা। তিনি ইসলামী আইন শাস্ত্রের উপর বিপুল জ্ঞান অর্জন করেন, পরবর্তীতে যা বিভিন্ন ইসলামিক রাজ্য তাকে কাজীর আসনে সম্মানিত করে।
১৩২৫ সালে হজ্জ পালনের জন্য তিনি তার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ার ছাড়েন। যখন তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। সে সময় সাধারণত মরক্কো থেকে হজ্জ করে আবার মরক্কোতে ফিরতে প্রায় ১৫ মাস সময় লেগে যেত। কিন্তু ইবনে বতুতা প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে তিনবার হজ্জ করে ২৪ বছর পর তার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ারে ফেরেন।
এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি তার নিবন্ধে লেখেন,
‘হজ্জ পালন ও বিশ্ব নবীর রওজা মোবারক জিয়ারতের জন্য ১৪ই জুন ১৩২৫ সালে আমি আমার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ার ছেড়ে যায়। সেই হিসেবে তখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর। এই পথে যাওয়ার জন্য সঙ্গী হিসেবে আমি কাউকেই পাইনি। কাফেলার খোঁজ করেও যখন আমি পেলাম না তখন একাই বেরিয়ে পড়লাম। সে সময় আমার মা-বাবা জীবিত ছিলেন। তাদের ছেড়ে আসাটা খুব কষ্টের ছিল। বিদায়বেলায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।’
ইবনে বতুতা প্রায় ৪৪টি দেশ ভ্রমণ করেন। বিশেষ করে তিনি সেই সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেন। ১৩৪৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছান। হজরত শাহ জালালে (রহ) সাহেবের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছায় এরপর তিনি সিলেট যাত্রা করেন। এক মাস পর তিনি সিলেট পৌঁছে হজরত শাহ জালাল (রহ) এর সঙ্গে দেখা করেন।
এরপর তিনি জাহাজ যোগে সোয়াহিলি উপকূল এবং মম্বাসা দ্বিপ ভ্রমণ করেন। ১৩৪৫ শেষের এর দিকে তিনি চিনের কুওানঝু প্রদেশে পৌঁছান। সেখানে স্থানীয় মুসলমানরা তাকে সাদর সম্ভাষণ জানান। ১৩৪৬ সালে তিনি পুনরায় মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।
অবশেষে ১৩৫৪ সালে জন্মভুমি মরক্কতে ফেরেন। দেশে ফেরার পর তিনি তার ভ্রমণ কাহিনি লেখা শুরু করেন। ‘A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of Travelling’ শিরোনামে এই লেখাটি তার ভ্রমণের একমাত্র নির্ভরযোগ্য দলিল।
এসএম
