ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

বিপ্লবী দেবেন ঘোষের ২২ তম মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার

বিপ্লবী দেবেন ঘোষের ২২ তম মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

উপমহাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ এক বিপ্লবী পুরুষের নাম। শৈশব থেকে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাদী যুদ্ধ নিপীড়ক পাকিস্তানের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে জেল জীবন ভোগ করেছেন। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন সামরিক শাসক ৮৫ বছর বয়সে তাকে জেলে নিক্ষেপ করেছিল। 

সারাজীবনের এক চতুর্থাংশ এর বেশী ২৬ বছর তিনি জেলজীবন ভোগ করেছিলেন। ১৯১৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ গ্রেপ্তার হন। শুরু হয় বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা। অল্প বয়সের কারণে সে সময়ের বিচারে তার দীপান্তর হয়নি। শুধুমাত্র সশস্ত্র সংগামের সংগঠক নয়-সমাজসেবায়-কর্মনিষ্ঠায়-সততায় দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ আজও এক দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যক্তিত্ব। ১১ জানুয়ারী এই সংগ্রামী পুরুষের ২২তম মৃত্যবার্ষিকী।

১৮৯০ সালের ২২ এপ্রিল দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ বরিশাল শহরের কাউনিয়া ক্লাব রোডের নিজস্ব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

যেদিন দেবেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। সে কারণেই বাবা নিবারণ ঘোষ ও মা রাজলক্ষ্মী ঘোষ আদর করে তার নাম রাখেন আবীর। পরবর্তীকালে এই আবীর সবাইকে আবীরে রাঙিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জেদী স্বভাবের এবং তখন থেকেই নিরন্ন মানুষের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। এমনও হয়েছে দুপুরে ভিখিরি এসে উঠোনে দাঁড়াতেই দেবেন্দ্রনাথ নিজের থালার ভাত ভিখিরিকে দিয়ে নিজে না খেয়ে থেকেছেন। আবার কোন দিন নিজের গায়ের শার্ট গরীব বন্ধুকে দিয়ে অবলীলায় খালি গায়ে বাড়ি ফিরেছেন।

দেবেন্দ্রনাথ তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত এবং তার সত্য প্রেম পবিত্রতার আলোকে উদ্ভাসিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। বলতে গেলে দেবেন্দ্রনাথের ভবিষৎ আদর্শিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রস্তুতি পর্বের সূত্রপাত ঘটে এখানেই। স্কুল জীবনে ব্রিটিশ বিরোধীতার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাকে সকল বিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯০৫ সালে ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন এবং বাংলার লাট ছিলেন ব্যামফিল্ড ফুলার। এই সময়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র। বরিশালে এই ঢেউ এর তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিশোর দেবেন্দ্রনাথকে। 


জাতীয় কংগ্রেসো বরিশাল অধিবেশন ব্যারিষ্টার আবদুর রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে এবং এই অধিবেশনকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হন দেবেন্দ্রনাথ। ১৯০৭ সালে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ গুহ ও যতীন্দ্র নাথ দাসের অনুপ্রেরণায় ভীম বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেণ্ড রায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন পাল, সুবোধ মল্লিক, তারকনাথ দাস, মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পুলিন মিত্রের নেতৃত্বে সদ্য কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন বিপ্লবী অনুশীলন দলে যোগ দেন দেবেন্দ্রনাথ। বরিশালে তখন অনুশীলন দলের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। বাহ্যিকভাবে অনুশীলন দলের কর্মকান্ড শরীর চর্চা, লাঠিখেলা, ছোরা খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ভেতরে চলত অস্ত্রশিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ। 


অনুশীলন দলের একটি গোপন ঘাঁটি ছিল তখন বাজার রোডে মুদী খানার পেছনে। আমানতগঞ্জের জলের কল এলাকা তখন ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এখানেও অনুশীলন দলের গোপন ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটির নেতৃত্ব দিতেন ইঞ্জিনিয়ার সুনীল ঘোষ এবং ওভারশিয়ার শশাঙ্ক ঘোষ। বাজার রোড বিস্ফোরণের কারণে হাসপাতাল রোডের ‘বেঙ্গল বোর্ডিং’ থেকে পুলিশ চন্ডী বসুকে ধরে নিয়ে যায়। নিজের বাড়ি থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং গোপাল মুখার্জীর বাসা হতে গ্রেপ্তার হন রমেশ আচার্য। তখন ব্রিটিশ সরকার এই বিপ্লবীদের নামে যে মামলা করেন তাতে বলা হয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আশ্রয় করে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টকে এরা খতম করতে চেয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত দলের কর্মকান্ড চালাবার দায়িত্ব দেয়া হয় যদুনাথ কুশারীর উপর। 


১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে যান। ১৯২৫ সালে বরিশালে ফিরে এসে নিজ ব্যায়ামগুরুর নামে প্রতিষ্ঠা করেন সূর্যকান্ত ব্যায়াম বিদ্যালয় যা বর্তমানে কাউনিয়া ক্লাব নামে পরিচিত। ১৯২৬ সালে বরিশাল কৃষি প্রদর্শনীর নামে জুয়া খেলা এবং কলসকাঠী গ্রামে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডির নির্দেশে মুসলিম হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান দেবেন্দ্রনাথ।১৯২৮ সালে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দল একীভূত হয়। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ আর এস পিতে যোগ দেন। তার এই বিপ্লবী কর্মকান্ডের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তারই ভাইপো দেব কুমার ঘোষ (মনাদা)। ১৯২৯ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন তিনি। 

এসময় স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে বরিশালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন ও বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৩১ সালে বারাসাত জেল হতে এনে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার জেলে তাকে ভিলেজ ডেটিনিউ হিসেবে আটকে রাখে।
বাঁকুড়া থেকে বরিশালে ফিরে আসতেই তাকে আবার ১৯৩৩ সালে গ্রেপ্তার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে রাজপুতানার দেউলী জেলে। জেলে জেলে ঘুরতে থাকে তার জীবনচক্র। ১৯৩৪ সালে জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে এবং তা বিলোপ হবার পক্ষে ফ্লাউড কমিশনে সাক্ষ্য দেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের আগমন কর্মসূচীকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এই কর্মসূচীতে তার সহযোগী ছিলেন শহীদ হীরালাল দাশগুপ্ত। এই সময় পাঁচ বছর তিনি জেলের ভেতরে কারাবন্দী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন। 

ব্রিটিশ রাজ বিদায় নেবার সময় তিনি জেল থেকে মুক্তি পান এবং সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে বরিশাল জেলার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে ‘যুব সংঘ’ গঠন করে একই সাথে দুর্ভিক্ষ মোচন ও কালোবাজারী দমনে নিয়োজিত হন। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা রাখায় তাকে পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তাবন্দীর নামে আটক করে। ১৯৫১ সালে স্থানীয়ভাবে সংগ্রাম কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন।

কুমিল্লায় সর্বদলীয় সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এর উদ্যোক্তা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথই। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অন্য প্রার্থীকে পরাজিত করে দেবেন্দ্রনাথ ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও শরীক হন দেবেন্দ্রনাথ। 


১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেবেন্দ্রনাথকে দেশরক্ষা আইনে বন্দী করা হয়। এক বছর পরে মুক্তি পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশ শত্র“মুক্ত হলে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশালেই রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগ দেন এবং বরিশাল জেলা বাকশালের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীতে তিনি জেলা গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের পরপরই তাকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। প্রায় ১ বছর তিনি জেল জুলুম ভোগ করে ছাড়া পান। অতি বৃদ্ধ হয়েও ৯০ এর পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক সকল কর্মকান্ড থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। 


সামরিক শাসন ও স্বৈরচারদের বিরুদ্ধে যখন কেউ কথা বলতেন না তখন তিনি নিশ্চুপ থাকতে পারতেন না। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটিই হয়ে উঠতেন অনলবর্ষী বক্তা। একাধারে তিনটি রাষ্ট্রের জেল জীবন ভোগ করে তিনি হয়েছিলেন “সংগ্রামী পুরুষ”। ১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারী এই মহাপ্রাণ সংগ্রামী পুরুষের জীবনাবসান ঘটে।


এসএমএইচ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন