যে রাতে প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ


লুৎফুননাহার সেই রাতের কথা এখনো ভোলেননি। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা কেউ কি ভোলে। ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ২৯ এপ্রিল দিনটি আজও তাঁর কাছে ভয়ের স্মৃতিবাহী।
লুৎফুননাহারের বাড়ি ছিল কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নে। এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা। বয়স তখন ১৩, স্কুলে পড়েন। আজও স্মরণ করতে পারেন, দিনটি মেঘলা ছিল। বয়স্করা বলছিল, বড় ঝড় হতে পারে। কিন্তু সে ঝড় যে এমন প্রলয়ংকরী হবে, তা ভেবেছিল কে। রাত বাড়তেই ঝোড়ো হাওয়া বাড়তে থাকে। উথালপাতাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে জনপদে। পরিবারের সবাই টিনের ঘরের ওপর আশ্রয় নেন। দেখেন, পানির তোড়ে একের পর এক বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে পানির ধাক্কা লাগে তাঁদের ঘরেও। পানিতে ডুবে হাবুডুবু খেতে খেতে এক নারকেলগাছ আঁকড়ে ধরেন এখন কক্সবাজার শহরে থাকা দুই সন্তানের এই মা। কিন্তু পানির তোড়ে ঘর থেকে খুলে আসা এক টিনের ধাক্কা লাগে শরীরে। ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে যান। এরপর সারা রাত পানির সঙ্গে লড়াই।
গৃহিণী লুৎফুননাহার মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। অপর প্রান্তে থাকা কণ্ঠটি ভয়ার্ত, কিন্তু স্পষ্ট। তিনি বলছিলেন, ‘একটার পর একটা ঢেউ আসে। বাড়ির সবাই কই গেল, তখন আর কিছু মনে নাই। কেবল ভাবছিলাম, কতক্ষণ পর মারা যাব।’
ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে সেদিনের সেই কিশোরীর দেহটি আটকে যায় পাশের ইউনিয়ন মাতারবাড়ীর একটি চরে। সকালের দিকে একদল লোক এসে মনে করেছিল, লাশ পড়ে আছে। কিন্তু মেয়েটি বেঁচে আছেন দেখে আশ্চর্য হয় সবাই। আহত, বিপর্যস্ত কিশোরীকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশখালীর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে হাতের ক্ষতচিহ্নে সেলাই বাঁধা হয়। এক আত্মীয় এসে তাঁকে সেদিনই নিয়ে যান কক্সবাজার শহরে। শরীরের নানা জায়গায় আঘাতে লোনাপানি মিশে পচন ধরে গিয়েছিল। কক্সবাজারের হাসপাতালের চিকিৎসক হাতের সেলাই খুলে দেখেন, সেখানেও পচন ধরে গেছে।
কামরুননাহারের হাতের সেই পচন রোধ হয়েছিল। তিন দিন পর বাড়ির কিশোরীটি বাড়িও ফিরেছিল। কিন্তু ভাই, ভাবি, তাঁর ৪ সন্তান, ফুফুসহ ১৮ জনকে ১৯৯১–এর সেই ভয়াল রাতের ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছিল। কিশোরী এর কিছুই জানত না। সেই রাতে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ফলে বুকের ব্যথা আজও কষ্ট দেয়। বেশি কষ্ট স্বজন হারানোর। সেই রাত এমন অনেক মানুষকে স্বজনহারা করেছিল। সরকারি হিসাবেই দক্ষিণ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৩৯ জন। সম্পদ নষ্ট হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকার।
ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। ঝড়ের স্মৃতি তাঁর স্মৃতিতে এখনো ভাসে। কামরুল বললেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ওই এক রাতে মারা গেছে। এমন কোনো পরিবার নেই যে স্বজনহারা হয়নি। একটিও স্থাপনা অক্ষত ছিল না। আর সেবার দুটো ওয়ার্ড সমুদ্রগর্ভে চলে যায়।’
কেন এত মৃত্যু
কক্সবাজারের উপজেলা কুতুবদিয়ার লেমশাখালী গ্রামের কামরুন্নেসা তখন নববধূ। ১৯৯১–এর ২২ এপ্রিল বিয়ে হয়েছিল এ জেলার পেকুয়া উপজেলায়। তবে সে বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন কামরুন্নেসা। পরীক্ষা ছিল ২ মে। পরীক্ষা দিতে বাবার বাড়ি এসেছিলেন। স্বামী সঙ্গে আসেননি, এসেছিলেন দেবর। ২৯ এপ্রিল আকাশের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু কামরুন্নেসার বাবা বললেন, বৈশাখ মাসে বড় তুফান হবে না। তাই এ পরিবারের সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকাই মনস্থ করে।
সেটাই ছিল বড় ভুল। বিশাল বিশাল ঢেউ যখন আছড়ে পড়ছিল গ্রামীণ এ গৃহস্থ বাড়িতে, তখন ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তবে সেই লড়াই একেবারেই অসম। আগ্রাসী ঢেউয়ের কাছে নিতান্ত দুর্বল প্রতিপক্ষ মানুষ। তাই তাদের সেই কালরাতে পুরো পরিবারের সবাই ঢেউয়ের তোড়ে কে যে কোথায় ভেসে গেল! কামরুন্নেসাও ভাসতে থাকলেন, আর একপর্যায়ে জ্ঞান হারালেন। উপজেলার সীমানা পেরিয়ে তাঁর অবসন্ন দেহটি পেলেন পেকুয়ার একদল মাঝি। এই মাঝিরাই তাঁকে উদ্ধার করে পৌঁছে দিলেন বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবারের সেই বাড়ি তখন খাঁ খাঁ করছে। আগের রাতের ভয়াল ঝড় তখন কামরুন্নেসার বাবা-মা, ভাবি, ভাই, তাঁদের ৪ সন্তানসহ ২০ জনকে নিয়ে গেছে। বলছিলেন, ‘এক ভয়ানক দিন। যার জীবনে আসবে না, তারা কোনো দিন বুঝবে না। আল্লাহ যেন এমন দিন কাউরে না দেন।’
কামরুন্নেসা জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ঝড় সম্পর্কে সঠিক ধারণা না পাওয়া। আবার, কাছের আশ্রয়কেন্দ্রটিও ছিল বেশ দূরে। সে সময় নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার বিষয়েও তৎপরতা তেমন ছিল না।
ঝড়ের পর এর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ব্র্যাকের কর্মকর্তা আহমেদ মুশতাক রাজা চৌধুরী। ‘দ্য বাংলাদেশ সাইক্লোন অব ১৯১৯: হোয়াই সো মেনি পিপল ডায়েড’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, শুধু কুতুবদিয়ায় ঝড়ে মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৩৩।
১৯৯১–এর ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির বড় কারণ হিসেবে ওই গবেষণা এবং একাধিক ব্যক্তির অভিমত, ওই দিন ঝড় সংঘটনের সময় জোয়ার মিলে গিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশে সিডর, আইলার মতো অনেক বেশি গতিবেগ নিয়ে হওয়া ঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কম। এর সঙ্গে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতের উন্নয়নের বিষয়টিও কারণ বটে। তবে জোয়ারের সঙ্গে ঝড় আছড়ে পড়ার সময়ের মিলন ক্ষতি ভয়ানক করে তুলেছিল। মুশতাক রাজা চৌধুরীর গবেষণায় বলা হয়, বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটে ঢেউয়ের তোড়ে মানুষ ভাসিয়ে নিয়ে। এখানে আরও কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে আছে দুর্বল গৃহকাঠামো, জনসংখ্যার ঘনত্ব, আশ্রয়কেন্দ্রের অপ্রতুলতা, দুর্বোধ্য দুর্যোগসংকেত।
১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ সেবার মারা যায়। ঝড়ের গতিবেগের নিরিখে ১৯৯১ ও ১৯৭০–এর মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। তবে ১৯৭০–এ বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়নি দেশে। এর মাঝখানে একটি শুধু বড় ঘূর্ণিঝড় হয় ১৯৮৫ সালে, উড়িরচরে। তবে তা একটি এলাকা ঘিরে সীমাবদ্ধ ছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান মনে করেন, ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডে একধরনের শ্লথতা সৃষ্টি হয়েছিল। বাস্তব কারণেই দেশের অন্য নানা বিষয়ে মনোযোগ ছিল।
২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের তিন উপজেলা আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পটিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল ৪২ হাজার মানুষের লাশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে এ তিন উপজেলায় কোনো তৎপরতা ছিল না।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) উপপরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘এ তিন উপকূলীয় উপজেলার পূর্ব পাশে ছিল পাহাড়। ধরে নেওয়া হয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় এলে মানুষজন পাহাড়ে আশ্রয় নেবে। বাস্তবে তা হয়নি। তিন উপজেলায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি হয়।’
মুশতাক রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গবেষণা পরিচালিত হয় চরম ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি ইউনিয়নে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে ৬৩ জন নিহতের ৬৩ শতাংশই ১৫ বছরের। আর পুরুষের চেয়ে নারীর মৃত্যু হয় অনেক বেশি। যেখানে প্রতি হাজারে ৭১ জন নারী নিহত হয়েছিলেন, সেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছিল ১৫।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন, ১৯৭০–এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার স্থানীয় মানুষদের নিয়োজিত করতে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৯১–এর আগে এখানে নারী স্বেচ্ছাসেবক ছিল না।
আব্দুল লতিফ খান বলেন, স্বামীকে ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনেক নারী রাজি ছিলেন না সে সময়। আর নারী উপস্থিতিহীন সিপিপি গ্রুপ নারীদের কেন্দ্রে আনতে পারেনি। নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার এটা একটা কারণ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: ২৯ এপ্রিলের শিক্ষা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সিপিপি কর্মীদের কাজে লাগানো ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ের শিক্ষা। আর ১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের বড় শিক্ষা নিয়ে সিপিপিতে নারী কর্মীদের নিয়োজিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। প্রথমে একটি ইউনিটে পাঁচজন নারী নেওয়া হয়। এখন নারী ও পুরুষের সংখ্যা সমান, ১০ জন করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সিপিপি কর্মীদের অবদান বিশ্ব স্বীকৃত। সারা দেশে এখন ১৩ জেলার ৪১ উপজেলার ৩৫৫টি ইউনিয়নে সিপিপি ইউনিট আছে। ইউনিট সংখ্যা ৩ হাজার ৭০১। সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক ৭৪ হাজার ২০ জন। এর অর্ধেক নারী।
১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রের অপ্রতুলতাকে প্রাণহানির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজারের বেশি মানুষের সংকুলান হতো না। অথচ এমন অনেক এলাকা দেখা গেছে, যেখানে মানুষের সংখ্যা আট হাজার। ২০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হয়েছে প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে।
২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর দেশে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৪০০, এখন ৫৬৬৫।
আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে; পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের তৎপরতা ও তাদের সরঞ্জাম। এখন একেকটি ইউনিটে আছে মেগা ফোন, সাইরেন, বাইসাইকেল, রেসকিউ কিট ও ফার্স্ট এইড বক্স।
প্রত্যেক সিপিপি স্বেচ্ছাসেবীর আছে গামবুট, রেইনকোট, হার্ড হ্যাট, লাইফ জ্যাকেট।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দুই দশকের বেশি সময় ধরে জড়িত রুহুল আমিন। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনায় প্রাযুক্তিক সুবিধা যোগ করা হয়েছে। দেশের ১৫৭টি এলাকায় ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সির (ভিএইচএফ) ওয়্যারলেস যুক্ত হয়েছে। মুঠোফোনের পরিষেবা প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছেছে। সেটাও সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজে লাগাচ্ছেন।
কাঠামোগত, প্রাযুক্তিক, লোকবলের সুবিধার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ১৯৯১ কে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞ লতিফ খান। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একাধিক সরকারি দপ্তরকে যুক্ত করার উদ্যোগ এরপর থেকেই শুরু। গত এক দশকে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী আদেশাবলি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। মাঠপর্যায়ের স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বিভিন্ন বাহিনীসহ প্রতিটি সংস্থার কাজ সুনির্দিষ্টভাবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রাণতৎপরতা
এরশাদ সরকারের পতনের পর একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে ১৯৯১ সালে। সেই সময় ত্রাণতৎপরতা প্রত্যক্ষভাবে দেখেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, সেই সময় ওই মহাদুর্যোগে ত্রাণসহ নানা কাজে প্রতিটি দলের অংশগ্রহণ এক অনুসরণীয় বিষয়। কিছুদিন আগেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মধ্যে সেই চেতনা ছিল।
১৯৯১–এর ত্রাণকাজ জটিল হয়ে উঠেছিল। অনেক দুর্গম জায়গায় সরকারি তৎপরতা পৌঁছানো যাচ্ছিল না। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কয়েক দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে অংশ নেওয়া মার্কিন নৌবহর অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল পরিচালনা করে বাংলাদেশের উপকূলে এসে। তারা মূলত ত্রাণকাজে অংশ নেয়। বেসরকারি সংগঠনগুলোর জোটের হয়ে মার্কিন বাহিনীর এই তৎপরতার সঙ্গে কাজের সমন্বয় করেছিলেন নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, তাঁদের বহরে হেলিকপ্টার ছিল। সেগুলো ব্যাপকভাবে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে লাগে।
দ্রুতই তখনকার দক্ষ সচিব হিসেবে পরিচিত এম মোকাম্মেল হকের নেতৃত্বে সরকারের প্রশাসনের একটি কমিটি গঠিত হয়। উপদ্রুত প্রতিটি উপজেলায় একজন উপসচিব দায়িত্বে থেকে ত্রাণকাজ সমন্বয় করেন। এর ওপরে ছিলেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তিরা। ত্রাণকাজে এই সমন্বয় তখন কাজে লেগেছিল বলে মনে করা হয়।
১৯৯১–এর পর সিডর, আইলা থেকে সর্বশেষ ২০২০ সালের আম্পান—বাংলাদেশ ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে নানা পর্যায়ের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করেছে। ১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানানো গিয়েছিল ১৫ ঘণ্টা আগে। আম্পানে তিন দিন আগেই তা জানানো হয়। এখন ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা এবং ত্রাণকাজ অনেক বেশি যে কাঠামোবদ্ধ, তা স্বীকার করেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রার নিরিখে ১৯৯১–এর চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির মাত্রা অনেক কম। এটা ব্যবস্থাপনার ফলেই হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
মো. এনামুর রহমান যেমনটা বললেন, বড় বড় ঝড় আঘাত হানার সময়ের ব্যবধান সত্যিই কমে আসছে। আবার উপদ্রুত এলাকার সংখ্যাও বাড়ছে। এখন দেশের ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ১৩ থেকে এ সংখ্যা ১৯ করা হয়েছে।
নতুন ছয় জেলা হলো: চাঁদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ।
ঝড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি কারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এই বাস্তবতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা দরকার। ১৯৯১–এ দেখেছি, প্রায় দুই সপ্তাহ পর সন্দ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারি ত্রাণ গেছে। এ সময়ে সেখানে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাই কাজ করেছে। এরা সেই মানুষ, যারা ঝড়ের আগেও থাকে, সময়েও থাকে, পরেও থাকে। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২–এর মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. মোহসীন অবশ্য মনে করেন, এখন স্থানীয় সরকার আগের চেয়ে ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি সম্পৃক্ত। এ প্রসঙ্গে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আদেশাবলি, ২০১০–এর কথা উল্লেখ করেন। সচিব বলেন, ঝুঁকি প্রশমন, জরুরি ত্রাণ এবং হুঁশিয়ারি সংকেত ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারের সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট করে বলা আছে। এখন ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি স্থানীয় সরকারকেন্দ্রিক।
/ইই
