ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

ভুল, অবিমৃশ্যকারিতা নাকি অন্যকিছু?

ভুল, অবিমৃশ্যকারিতা নাকি অন্যকিছু?
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

এ কি তবে কোন ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস? তা না হলে কেন এমনটা হবে? এতো মোটেই কোন স্বাভাবিক লক্ষণ নয়। পথ ভোলারও তো একটা সীমা পরিসীমা থাকে। এতো একেবারে জলের মাছের ডাঙায় ঘুরে ফিরে বেড়াবার মতো বিষয়! না কি তার থেকেও বিস্ময়কর? ব্যাপারটা নিশ্চয়ই প্রচার মাধ্যমের কারণে সম্ভবত সবাই প্রায় জেনে গেছে, তবে এখনো যারা জানতে পারেনি, এ খবরগুলো হয়তো তাদের জন্য নয়। 

খবরটা কি? নিশ্চয়ই অদ্ভুত কোন দারুন খবর? বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচারিত সেই খবরটা হলো, পদ্মার জেলের জালে এক পাখি মাঁছ ধারা পড়েছে! নদীমাতৃক এই দেশে ইতপূর্বে কেউ কি কোথাও কখনো ‘পাখিমাছ’ নামে কোন মাছের নাম শুনেছেন? এরকম একটা অবাক বিস্ময়ের খবর এই প্রথম। এ যেন হাতির গাছে উঠে পাতা খাওয়ার গল্প। যে গল্পের কাছে আষাঢ়ের সমস্ত গল্প নস্যি বনে গেছে। তাহলে ব্যাপারটা কি?

জানা গেছে, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সেইল ফিশ ধরা পড়েছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর জেলেদের জালে! মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ISTIOPHORUS PLATYPTERUS এই  সেইল ফিশের আর একটি প্রজাতি ISTIOPHORUS ALBICANS যা সাধারণভাবে আটলান্টিক সেইল ফিশ নামে পরিচিত। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অর্থাৎ দ্বিতীয়টিই হলো মহাসাগরের সব থেকে দ্রুতগতি সম্পন্ন প্রাণি। মাছটি না কি ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। এর পিঠের উপরের পাখাটি দেখতে অনেকটা নৌকার পালের মতো, তাই এর নাম সেইল ফিশ। মাছটি বহুরূপী। শিকারির সামনে পড়ে গেলেই সে রঙ বদল করতে পারে। এমন একটি বিস্ময়কর মহাসাগরের মাছ লবন পানি ছেড়ে পদ্মার মিঠা পানিতে কেমন করে এলো এবং কেন এলো?


দেশের মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ধারণা মাছটি মহাসাগর থেকে সাগরে, অত:পর পথ ভুল করে পদ্মায় চলে এসেছে! ভাবা যায়, কি অসাধারণ অদ্ভুত ভুল এটি? এই ভুলটি করতে মাছটিকে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে? মাইলের হিসাবে তার পরিমাণটা কত হবে? বিষয়টি পরিবেশবিদ এবং প্রাণিবিদগন জ্ঞান বৃদ্ধির তাগিদে ভেবে দেখতে পারেন। 

আসলে এতটা সহজ করে কিছু দেখতে বা ভাবতে নেই। তাহলে সত্য পথ হারায়। এইতো মাত্র সেদিন শাহ্জালাল রো-রো ফেরী, পরিপূর্ণ অবস্থায় সোজা সজোরে আঘাত হানলো, বাংলাদেশে এই মূহূর্তে সব থেকে স্পর্শকাতর স্থাপনা পদ্মা সেতুর সতেরো নম্বর পিলারে। কিভাবে দেখবো একে? পথের ভুল, তেল চুরির প্রয়োজনে শর্টকাট পথে যাবার চেষ্টা, ষ্টিয়ারিং কাজ না করা, পদ্মার পানির ¯্রােতের টানে নিয়ন্ত্রণ হারানো, না কি মাস্টার দেখতেই পাননি সামনে একটা ব্রিজ, কোনটা? এই যে এতগুলো কারণ লিখলাম এর ভিতরে সত্য, সঠিক কারণটি কি আছে? থাকলে ভালো। শুধু ভালো নয়, খুব ভালো। না থাকলে বলবো, সাবধান! কেউ একে ভুল বলে চালাবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আবারো ভুল হয়ে যাবে। তাহলে মাছের গল্পের সঙ্গে মিলে মিশে বিষয়টা লেজে-গোবরে হয়ে যাবে।

কারণ, আমরা অনেক কিছুরই কারণটা জানতে পারি না। যেমন এই  সেইল ফিশটি কি ভুল করে পদ্মায় এসেছে? নাকি তাকে তাড়া করেছে কোন ভয়ঙ্কর হাঙ্গর বা কোন প্রতিপক্ষ? হয়তো তার সেই ধারালো দাঁত থেকে বাঁচতে সে এসে মরেছে পদ্মায় জেলের জালে। অতএব সাবধান কেন হবো না, ওই মাছের খোঁজে এই পদ্মায় যদি হাঙ্গর এসে পড়ে? সেখানে এখন কেবল মিঠা পানিই নয়, আছে সুস্বাদু ইলিশ, বোয়াল, চিতল, কোরাল, পাঙ্গাশ। আছে এক দুই করে বিয়াল্লিশটি স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পিলার। যে পিলারে দাঁত বসাবে বলে অজ¯্র হাঙ্গর আছে ঘরে। এই হাঙ্গর সুযোগ পেলে প্রয়োজনে আসতে পারে সাগর মহাসাগর বেয়ে। অতএব সাবধান!

মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে পদ্মা সেতুর ১৬ এবং ১৭ নম্বর পিলারে  ফেরীর আঘাত। একে শুধু ভুল বলবার সুযোগ কই? দেখা যাচ্ছে যে, তদন্ত কমিটি সহজ উত্তর দিয়ে পাশ কাটাচ্ছেন। বলতে পারছেন না কেন মাস্টার নির্দিষ্ট পথের বাইরে ফেরী চালালো কার অনুমতি বা নির্দেশে? সে কারণ জানতে হবে, খুঁজতে হবে এই হাঙ্গরদের সঠিক অবস্থান। এখানে ভুল করবার কোন জায়গা নেই। তাহলেই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়তে পারে জাতি।

ভুল যে শুধুই লজ্জার জন্ম দেয়, তা কিন্তু নয়। জটিল কোন ভুল অস্তিত্ব অবস্থান এবং সর্বইভো পদস্খলন পর্যন্ত ঘটিয়ে দিতে পারে। তাহলে দেখবে কে, খুজঁবে কে? সকল কিছুতে একক অস্তিত্ব আখেরে হতাশারই জন্ম দেয়। অনবরত অযোগ্যদের সীমাহীন বিচরণ কেমন লজ্জিত করে চলেছে সময়।

তেমন একটি ঘটনা। স্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ি পশুর হাট। তারিখ উনিশ‘শ একুশ সালের চৌদ্দই এপ্রিল। এই হাটে বাংলাদেশ সরকারের অত্যন্ত করিৎকর্মা রাজস্ব বিভাগের কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাটের এবং বিজিবি সদস্যরা মিলে বাইশটি গরু ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত করে আটক করে। অতঃপর সেগুলি নিলামে তুলে বিক্রিও করে দেয়। এমন উপায়অন্তহীন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত গরুর মালিকেরা স্মরণাপন্ন হন রাজশাহীর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে। 

পরিচালক তখন সহযোগিতা কামনা করেন বিভাগীয় কমিশনার বরাবর। বিভাগীয় কমিশনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তদন্তের দায়িত্ব দেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালককে। আমি ঠিক জানি না, ওই তদন্ত কর্মকর্তা নিলামকারীদের কাছে ভারতীয় গরুদের আসার কার্ড দেখতে চেয়েছিলেন কিনা। তবে এইটুকু জানা গেছে ওই তদন্ত কর্মকর্তা উনিশে জুলাই দুই হাজার একুশ রাজশাহী গোমস্তাপুরে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রমাণ পেয়েছেন, ওই বাইশটি গরুই স্থানীয় অতি দরিদ্রদের বাড়িতে পোষা। যাদের মধ্যে নারী আছে চার জন। তাদের একজন কুলসুম বেগম বলেছেন, ধার দেনা করে আমি দ‘ুটি গরু পুষে ছিলাম ‘এখন তারা টাকা চাহাছে’ ঘরেই খাবার নাই। ঘরে আছে তিন সন্তান আর প্রতিবন্ধী স্বামী। ওই গরুই ছিল তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। এখন সে টাকা কি করে দেবো?

এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিলীন হয়ে যায় কান্নায় কিংবা বীভৎস হাসিতে। আমার এক বন্ধু পরিবেশ ফেলো, তাকে একদিন কৃষ্ণচুড়ার ফল, যা কাঁচা অবস্থায় থাকে গাঢ় সবুজ, আর ভিতরে থাকে বীজ। সেই ফল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘বলতো ওই যে লাল ফুলের পাশে সবুজ রঙের কিছু একটা ঝুলে আছে ওগুলো কি?’ বন্ধু পরিবেশ বিষয়ক জ্ঞানী কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললো ‘আরে এগুলোতো মৌসিমী।’ বন্ধুর সেদিনের উত্তরটা মিলিয়ে গিয়েছিল হাসিতে। তবে গরুর মালিকদের প্রশ্নের উত্তর যথার্থ দিয়েছিলেন রাজশহীর ওই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, গরু নিলাম ঘটনায় সম্পৃক্ত সকল গরুগুলি ছিল বাংলাদেশের।

সেইল ফিশের পদ্মা ভ্রমণ ভুল, পদ্মা সেতুর ষোল এবং সতেরো নম্বর পিলারে নিকট অতীত সময়ের মধ্যে পর পর দু বার ফেরীর সজোরে আঘাত ভুল, দেশের অভ্যন্তরে বৈধ পশুর হাটে ঢুকে পশুর এনআইডি কিংবা আদার কার্ডের(?) অনুসন্ধান ভুল। এ সবই কি ভুল, নাকি রজ্জুতে সর্পভ্রম, এমন ভুল বোঝানোর গল্প? না কোন মহাপ্রলয়ের আগাম সতর্কবাণী? ভুল হলে সমস্যা নেই কিন্তু তা যদি না হয়? সাবধান! ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সচেতন না হলে। যদিও প্রমাণ আছে ভুরিভুরি, আছে প্রবাদ ‘কাঙালের কথা নগদে নয়, বাসি হলে তবে ফলে।’

পদ্মায় সেইল ফিশের আগমন নিয়ে না প্রাণি না পরিবেশবীদ কোথাও কেউ একটি শব্দও ভেবেছে বলে শুনিনি। পদ্মা সেতুর দুই পিলারে পর পর ফেরীর সজোরে আঘাত, তদন্তে নেমেছে রাষ্ট্র। রাজশাহীর বিজিবি ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক-১ বলেছেন ‘হয়তো ভুল হয়েছে। অনুসন্ধান চলছে প্রমাণ হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’ 

এখনো ভালো করে বুঝতে পারিনি এমন ভুলগুলিতে কোথায় কি কি ক্ষতি হয়েছে? কে কিভাবে নিরুপন করবে এই ক্ষতিপূরণ? এসকল ঘটনা প্রকৃতপক্ষে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, অযোগ্যদের অনবরত সীমাহীন বিচরণ কিংবা অতি অবশ্য সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তার দিকে। আর তা না হলে এই অপ্রস্তুত করবার বিষয়গুলি ভবিষ্যতে আমাদের লজ্জিত আর ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিঃসন্দেহে।

 

......আজমল হোসেন লাবু
 


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন