ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news
কলাপাড়া

আশ্রয়ণ প্রকল্পে হরিলুট, আড়াই কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ 

আশ্রয়ণ প্রকল্পে হরিলুট, আড়াই কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ 
কলাপাড়ার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনে গৃহীত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পটি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। গৃহ প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবারকে উপকারভোগী নির্বাচন না করে ৩০/৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাস জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তিদের বিবেচনায় নেয়নি টাস্কফোর্স কমিটি। এমনকি একই নামে দু’টি ঘর বরাদ্দ দেয়ার তথ্য রয়েছে তালিকায়। এছাড়া নিম্ন মানের উপকরণ সামগ্রী ব্যবহার সহ রাজমিস্ত্রী, কাঠ মিস্ত্রী’র মজুরী এবং পরিবহন ও জ্বালানি খরচ উপকারভোগীদের প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। এতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লোপাটের তথ্য ফাঁস হয়ে পড়েছে। 

ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’র আলোকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপকারভোগীদের নামের তালিকা নির্ভুল ভাবে সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। ৩৯৪ বর্গফুটের ২কক্ষ বিশিষ্ট পাকা/সেমিপাকা গৃহে ১টি টয়লেট, ১টি রান্নার কক্ষ ও ইউটিলিটি স্পেস গুণগত মান সম্পন্ন উপকরণ সামগ্রী দিয়ে তৈরী করা হয়নি। তালিকাভুক্ত উপকারভোগী ’ক’ শ্রেণী যার জমি ও ঘর কিছুই নেই, ’খ’ শ্রেণী যার এক থেকে ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ করার কথা। আর যাদের জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত পূর্বক ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা কমিটি’র সভাপতি ইউএনও, সদস্য এসি ল্যান্ড, এলজিইডি প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্য সচিব পিআইও। এ কমিটি গৃহনির্মাণ কাজের অগ্রগতি উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় ও টাস্কফোর্স কমিটির সভায় অবহিত করবে, কিন্তু তা করা হয়নি।

 এছাড়া সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণ উপকরণ সামগ্রীর গুণগত মান ও তৈরীকৃত গৃহের নকশা যাচাই করা হয়নি। ঘরের নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে প্রথম ধাপে ৪৫০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহন ও জ্বালানি খরচের ১৮ লক্ষ ২৫ হাজার এবং দ্বিতীয় ধাপে ১১০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহন ও জ¦ালানি খরচের ৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা সহ মোট ২৩ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫৬০টি বরাদ্দকৃত ঘরের জন্য উপকারভোগী প্রতি ৩০/৪০ হাজার টাকা হারে প্রায় ২ কোটি টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এনিয়ে প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী’র কাছে রেজিষ্ট্রী ডাক যোগে আবেদন করেছেন ধূলাসার ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের বাদল খান নামের একজন ভুক্তভোগী। 

ভুক্তভোগী বাদল খান তার লিখিত অভিযোগে বলেন, ’ধূলাসার ইউনিয়নে ইউএনও’র নামে চেয়ারম্যান মোস্তাক মেম্বরকে দিয়ে ঘর প্রতি ৩৫ হাজার টাকা করে মোট ২৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া ঘর তৈরীতে নিম্নমানের ইট, বালু, সিমেন্ট ব্যবহার করায় ইসমাইল হাওলাদার, বাদল, দুলাল ও রত্তন মোল্লার ঘর নির্মাণের পর পরই ভেঙে পড়ে, যা তড়ি ঘড়ি করে আবার কোনরকম মেরামত করা হয়।’ বাদল খান আরও বলেন ’পশ্চিম ধূলাসার গ্রামের মৃত নাসির গাজীর পুত্র মো: সুমন গাজীকে পশ্চিম চাপলি ও চরচাপলি গ্রামের বাসিন্দা দর্শাইয়া একই নামে দু’টি ঘর বরাদ্দ দিয়ে চেয়ারম্যান মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়, যা নামের তালিকার ২৭৮ ও ২৯৭ নম্বরে দৃশ্যমান।’

একই গ্রামের দুলাল হাওলাদারের স্ত্রী আমেনা বেগম (৩২) বলেন, ‘ঘর পেতে দুই কিস্তিতে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি।’ আ: ছালাম সিকদারের মা রওশনারা (৫৫) বলেন, ’ঘর পেতে ৩৪ হাজার টাকা ওয়ার্ড আ’লীগ সেক্রেটারী জসিম মোল্লা’র কাছে দিয়েছি। টাকা নেওয়ার সময় টিউবওয়েল ও জায়গা দেয়ারও কথা ছিল। কিন্তু কিছুই দেয়নি, পচা ইট দিয়ে ঘর করে দিয়েছে।’ অভিযুক্ত জসিম মোল্লা টাকা উত্তোলনের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ’চেয়ারম্যান ও মোস্তাক মেম্বর আমাকে ঘর প্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ বাবদ উত্তোলন করতে বলায় আমি টাকা উঠিয়ে তাদের দিয়েছি। পরে এসব ঘর প্রধানমন্ত্রী আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়েছে জানতে পেরে আমি অনুতপ্ত।’ ধূলাসার ইউপি চেয়ারম্যান আ: জলিল আকন ও মোস্তাক মেম্বর এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।      

 

 
লতাচাপলী ইউনিয়নের থঞ্জুপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আবুবকর খান (৩৮) বলেন, ’ঘর বরাদ্দ পেতে আমার ৩৫/৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। মেম্বর হারুন ভদ্র এ টাকা নিয়েছে। এছাড়া কেরিং খরচ, মিস্ত্রীদের মজুরী ও খাওয়া খরচ তো আছেই। এখন আবার শুনছি টয়লেটের মালামাল দেবে না, নিজ খরচে টয়লেট ঘরের বাইরে বসাতে হবে।’ একই ওয়ার্ডের ইসমাইল (৩২) বলেন, ’মেম্বরকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি ঘর পাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘর পাইনি।’ অভিযুক্ত মেম্বর মো: হারুন ভদ্র বলেন, ’আমার ওয়ার্ডে ৩টি ঘর পেয়েছে। এসব ঘরের জন্য কিছু টাকা খরচ বাবদ নেয়া হয়েছে, তবে তারা যে অংক বলছে তা সঠিক না।’ একই ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের নওমুসলিম হাসান খান বলেন, ’ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও অফিস খরচের জন্য লতাচাপলী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ মজিবুর রহমান মুসুল্লী ১৫ হাজার টাকা নেন। ৮টি ছাগল বিক্রি করে আমি ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর ১০দিন কাজ করে রাজমিস্ত্রী সহকারীর বেতন বাবদ ১০ হাজার টাকা নেয় ঠিকাদার মোঃ ওয়াদুদ খান। মিস্ত্রীদের দুপুরের খাবার তো আছেই।’ লতাচাপলী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আনছার উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ’এসব লেনদেনের বিষয়ে আমার জানা নেই।’ এছাড়া পার্শ্ববর্তী বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার কড়াইবুনিয়া ইউনিয়নের নীলগঞ্জ গ্রামের তৈয়ব আলী চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরবুনিয়া গ্রামের ভুয়া ঠিকানা দেখিয়ে ঘর বরাদ্দ পায়, যা তালিকার ৮নম্বরে দৃশ্যমান। তিনি উক্ত ঘর আমতলীর স্থায়ী ঠিকানায় উত্তোলন করেন।
উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বাবুল খান বলেন, ’ভূমিহীন, আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় কত ঘর এসেছে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, এটা আমাদের ব্যাপার। আমার কাছে ঘর এসেছে। এটা আপনি কে জানতে?’  বাবুল খান আরও বলেন, ’আমি মহিপুরের ১টি দুস্থ পরিবারকে তার কার্যালয়ে এনে প্রদর্শনপূর্বক আবেদনে সুপারিশ করার পরও সে ঘর পায়নি। ইউএনও কার্যালয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে গোপন বৈঠক করে ৪০/৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর দেয়া হয়েছে।’    

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব পিআইও মো: হুমায়ুন কবির বলেন, ’আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর সংক্রান্ত সকল ফাইল, পত্র ইউএনও স্যারের কাছে। স্যার এটির আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলী মহর আলী বলেন, ’ঘর সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখলেও কোন মিটিংয়ে আমাকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়নি। তাই এ সম্পর্কিত কোন তথ্য আমার কাছে নেই।’ 

সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎবন্ধু মন্ডল বলেন, ’শুধুমাত্র খাস জমি বরাদ্দের আবেদন যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমি ছিলাম। অন্য কোন বিষয়ে মন্তব্য করা আমার এখতিয়ার বহির্ভূত।’ ইউএনও আবু হাসনাত মোহম্মদ শহিদুল হক বলেন, ’এ সংক্রান্ত কোন অভিযোগ আমার কাছে আসে নাই। তাছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য আমি কাউকে দায়িত্বও দেই নাই। যদি কেউ টাকা উত্তোলন করে তার নিজ দায়িত্বে করেছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করার পরামর্শ দেন তিনি।’ পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো: মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন,’এ ধরনের অভিযোগের বিষয় তদন্তে প্রমানিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প’র পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো: মাহবুব হোসেন বলেন, ’আশ্রয়ন প্রকল্পের নীতিমালা বহির্ভূত ভাবে ঘর বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ নাই। যদি কেউ নীতিমালা বহির্ভূত ভাবে ঘর বরাদ্দ দেয় সে বিপদে পড়বে।’
 


মো. এনামুল হক / এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন