ঈদের ছুটিতে ফাঁকা বরিশাল, বাড়তি সতর্কতা পুলিশের


ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে আগেই বন্ধ হয়েছে স্কুল-কলেজ। এরপর গত বৃহস্পতিবার দিনের কর্ম দিবসের পর বন্ধ হয়েছে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি অফিস। ঈদের ছুটিতে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করতে ইতোমধ্যে বাড়িতে গেছেন বরিশাল নগরীর অনেক বাসিন্দা।
এতে ব্যস্ত নগরীর রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা। আগের মতো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে না থেকে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। শনিবার সকালে নগরীর আমতলা মোড়, সদর রোড, জিলা স্কুল মোড়, চৌমাথা ও হাসপাতাল রোড এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ঈদযাত্রায় যাত্রীদের যেন কোনো ভোগান্তিতে না পড়তে হয়, সেজন্য নগরীর নদী বন্দর, নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল ও রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় প্রবেশের মুখে পুলিশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করচ্ছেন। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
নগরীর রূপাতলী বাসটার্মিনাল থেকে সদর রোডে আসার জন্য অপেক্ষা করা সিএনজি অটোরিকশা চালক শরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার বিকেল থেকেই নগরীতে তেমন লোকজন নেই। আজ (শনিবারও) একই অবস্থা। যাত্রী পাওয়া বড় কষ্ট হচ্ছে।
একই এলাকায় সড়কে গাড়ির চাপ কম থাকায় স্বস্তিতে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মাহবুব আলম বলেন, আজকে (শনিবার) তেমন গাড়ির চাপ নেই। সকাল থেকেই প্রাইভেটকার বা ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ অনেক কম। ঈদের সময় স্বাভাবিকভাবেই নগরী থেকে মানুষের চাপ কমে যায়।
ফলে সড়ক অনেকটাই ফাঁকা থাকে। তবে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে যে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা করা হচ্ছে।
এদিকে কিন্তু মহাসড়কে যানজটের কারণে দূরপাল্লার বাসগুলো নগরীতে প্রবেশ করতে দেরি হচ্ছে। এতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। শত ভোগান্তির পরও বাড়ি ফিরতে উন্মুখ হয়ে রয়েছেন যাত্রীরা।
পাশাপাশি ঈদুল আজহা উপলক্ষে অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে মহাসড়কে অভিযান পরিচালনা করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। এ সময় রুট পারমিটবিহীন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধে সাত মামলায় ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে জেলা প্রশাসনের মিডিয়া সেল সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জেলার গৌরনদী, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, বরিশাল সদর ও বাকেরগঞ্জ উপজেলায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
অভিযানের সময় স্পিডমিটার দিয়ে গাড়ির গতিসীমা পরীক্ষা করার পাশাপাশি দূরপাল্লার গাড়িগুলোকে মহাসড়কে গতিসীমা মেনে চলতে সতর্ক করা হয়।
একই সময় রুট পারমিটবিহীন গাড়ি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর বিধান মোতাবেক সাতটি মামলায় ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে পরিবহনে বাড়তি ভাড়া দিয়ে গন্তব্য আসছেন মানুষ। সরকারি বিআরটিসি বাসেও ˜িগুণ ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন তারা।
আব্দুল ওয়াদুদ নামে এক যাত্রী বলেন, নিয়মিতই তিনি বিআরটিসিতে যাতায়াত করেন। কিন্তু শুক্রবারের যাত্রা তার কাছে চরম ভোগান্তির ছিল।
তিনি বলেন, সাধারণত ৬০০ টাকা ভাড়া হলেও ৫০০ টাকায় যাত্রী আনা নেওয়া করে বিআরটিসি। কিন্তু শুক্রবার ১০০০ টাকা দিয়ে টিকেট নিতে হয়েছে। দালালের কাছ থেকে নয়, গুলিস্তান বিআরটিসির কাউন্টার থেকেই এই টাকায় টিকিট নিয়েছি।
তিনি বলেন, মুখে যে যা বলুক, বাস্তবতা দেখতে ঈদযাত্রায় বাসের যাত্রী হয়ে দেখা উচিত তাদের। সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। সকাল ৯টায় গুলিস্তান থেকে বাস ছেড়েছে। বিকেল সাড়ে ৩টায় বরিশালে পৌঁছেছি।
শুধু আব্দুল ওয়াদুদই নয়, চরম ভোগান্তির কথা তুলে ধরলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাসগুলোর যাত্রীরাও। বরিশালের রূপাতলী ও নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় এসব যাত্রীদের সঙ্গে।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সায়েদাবাদ থেকে আল আমিন পরিবহনে এসেছেন খলিলুর রহমান। যাবেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগা।
খলিলুর বলেন, শনিবার ভোর ৬টায় সায়েদাবাদ গিয়ে সাড়ে ৯টার গাড়িতে টিকিট পেয়েছি। আগে ৫০০ টাকা হলেও আজকে (শনিবার) ৮০০ টাকা করে টিকিট নিয়েছে। পদ্মা সেতুর টোলে যানজট থাকায় আসতে দেরি হয়েছে। আমরা নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে এসে পৌঁছিছে
৩টা ২৮ মিনিটে। মানে আগে যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় আসতাম, আসলাম সাড়ে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময়ে। তার সঙ্গে থাকা কহিনূর বেগম বলেন, এর চেয়ে লঞ্চের যাত্রা ভালো ছিল। বাসে পথে পথে নৈরাজ্য। হেল্পার, কন্ডাকটাররা যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করে। যেখানে খুশি সেখানে থামিয়ে রাখে। ভোগান্তির অন্ত নেই বরিশালের রুটে।
আরেক যাত্রী ইমরান বলেন, ঢাকা-কুয়াকাটা রুটের শ্যামলী বাসে ভাড়া রেখেছে ৮০০ টাকা। সবগুলো বাসই একসাথে ভাড়া বাড়িয়েছে। ঈদে এলেই সড়কে বাস শ্রমিক-মালিকরা নৈরাজ্য করে। সরকার প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেয় না। শুধু মুখে মুখে আশ্বাস দেয়।
শুধু ঢাকা বরিশাল রুটেই নয়, ঢাকা-কুয়াকাটা, ঢাকা-বাউফল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর, ভান্ডারিয়া, স্বরুপকাঠিসহ যতগুলো রুট রয়েছে সবগুলো রুটেই ভাড়া বাড়িয়েছে প্রতিটি পরিবহন।
পিরোজপুর রুটের ইমাদ পরিবহনের যাত্রী শফিকুল ইসলাম হৃদয় বলেন, ঢাকা থেকে সড়ক পথে বাড়ি ফেরাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। প্রতিটি গাড়ি বেপরোয়াভাবে ড্রাইভ করে।
যাত্রীরা আনন্দ করতে বাড়ি ফিরলেও বাসের বেপরোয়া গতি সব সময়ে টেনশনে রাখে কখন দুর্ঘটনায় পতিত হই। তাছাড়া আগের চেয়ে আড়াইশ টাকা বেশি নিয়েছে টিকিটের মূল্য।
কুয়াকাটাগামী হানিফ পরিবহনের যাত্রী সাদিয়া আক্তার বলেন, আমি নলছিটির দপদপিয়া জিরো পয়েন্ট মোড়ে নেমেছি। অথচ আমার কাছ থেকে কুয়াকাটার ভাড়া নিয়েছে। বাসে এমনভাবে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে যা বলে শেষ করা যাবে না।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঈদযাত্রায় মানুষ বাড়ি ফিরছে। বরিশাল থেকে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও সড়কে চলাচলে বিঘ্ন যেন না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে।
তিনি বলেন, যাত্রীরা যেন নিরাপদে কর্মস্থলে ফিরতে পারে সেজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবগুলো ইউনিট সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
বিআরটিসি বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বরিশাল ডিপোর ম্যানেজার জামিল হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে বরিশাল, বাউফল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, কুয়াকাটা রুটে আমাদের সার্ভিস রয়েছে।
এর কোনো স্টেশনে ১ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারিত নয়। কিন্তু ঢাকা থেকে বরিশাল ১ হাজার টাকা যে বাসটি ভাড়া রেখেছে সেটি বাউফল রুটের। কেন আসলে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করেছে তা খতিয়ে দেখে আদায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে নদীপথে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিরাপদ করতে বরিশালে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। গতকাল সকাল থেকে নদী বন্দরে টহল দিতে দেখা যায় তাদের। মেহেন্দিগঞ্জ ও ভোলামুখী যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। দক্ষিণ জোন কোস্টগার্ডের সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মকবুল হোসেনের উপস্থিতিতে সদস্যরা রুট পারমিটসহ বিভিন্ন লঞ্চের চলাচলের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করেছেন।
পাশাপাশি সার্ভে সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা সরঞ্জাম রয়েছে কিনা, তা যেমন পরীক্ষা করেছে, তেমনি লঞ্চে নিয়মানুযায়ী দক্ষ মাস্টার, সুকানী, ড্রাইভারের উপস্থিতিও পরীক্ষা করেছেন তারা। এছাড়া বন্দরের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তির ব্যাগও তল্লাশি করা হচ্ছে।
লঞ্চের মাস্টাররা জানিয়েছেন, কোস্টগার্ডের উপস্থিতির কারণে টার্মিনালে শৃঙ্খলা ফিরেছে। কেউ নির্ধারিত সময়ের বেশি অপেক্ষা করে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী নেওয়ার কথা ভাবছেন না, ফলে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কাও কম রয়েছে। কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে চালক ও যাত্রীদের সতর্ক করতে মাইকিং করা হচ্ছে।
এইচকেআর
