ইউনিয়ন পরিষদের সামনে সারিবদ্ধ নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জাল


বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সামনে তাকালে যে কারো চোখ আটকে যাবে মাঠে লম্বা সারিবদ্ধ করে শুকতে রাখা ‘চায়না দুয়ারি’ জাল দেখে। জালটি কারেন্ট জালের মতো মিহি ও হালকা। এ জাল দিয়ে সূন্ক্ষভাবে মাছ ধরা সম্ভব। এ জাল সরকার নিষিদ্ধ করলেও জেলেরা অবাদে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে ফেলে মাছ ধরছে। জালে আটকা পড়ছে ছোট বড় সব মাছই। নিষিদ্ধ এ জাল জেলেরা নদী থেকে ফিরে ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে শুকাচ্ছেন মাসের পর মাস। কিন্তু কেউ জানেনই না এ জাল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলেদের অনেকে এ জাল ব্যবহার করে খুশি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এ জাল মাছসহ জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য কারেন্ট জালের চাইতেও ক্ষতিকর। অবশেষে সোমবার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন নাহার খবর পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নিষিদ্ধ এ জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলেন।
জানা যায়, গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নটি বিষখালী নদী বেষ্টিত। নদীর তীরে বাস করেন শতাধিক জেলে পরিবার। যারা নদীতে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ সরকারের আইন মেনে, কেউ আবার নিষিদ্ধ জাল ফেলে ধরছেন বিষখালী নদীতে মাছ। সবচেয়ে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জালও ব্যবহার করছেন জেলেরা। তাদের এ জালে ধরা পড়ছে ছোট বড় সব ধরণের মাছই। এমনকি মাছের রেনুও (গুড়া মাছ) বাদ যাচ্ছে না জেলেদের এই জাল থেকে। যা গুড়া মাছ হিসেবে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
কয়েকজন জেলে জানান, এক সময় পদ্মা নদীতে চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ ধরতেন জেলেরা। সেখান থেকেই এই জাল ছড়িয়ে পড়ে দেশের নদী বেষ্টিত জেলাগুলোতে। এর মধ্যে ঝালকাঠির জেলেরা এ জাল দিয়ে সম্প্রতি মাছ ধরা শুরু করেছেন। ফরিদপুর থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নদীতীরের জেলেদের কাছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করে যাচ্ছেন এ জাল। সদর উপজেলার পূর্ব বিন্না পাড়া, ছত্রকান্দা, দেউলকাঠি, বৈদারাপুর ও চর ভাটারাকান্দা এলাকার জেলেরা এ জাল ব্যবহার করছেন। জালে উঠছে সব ধরণের মাছ, এতে খুশি জেলেরা। তাই অনেকেই নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার না করে চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এ জালটি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণ না থাকায় কেউ মাছ ধরতে বাধাও দিচ্ছেন না। এমনকি প্রশাসন কিংবা মৎস্য বিভাগের কাছেও এ জাল সম্পর্কে কোন অভিযোগও আসছে না। তাই মাছ ধরে খোলা মাঠে আবার জাল শুকাচ্ছেন জেলেরা।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চায়না দুয়ারি জাল মূলত মাছ ধরার এক ধরণের ফাঁদ। এ জালের বুননে একটি গিঁঠ থেকে আরেকটি গিঁঠের দূরত্ব খুব কম, যে কারণে এতে মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারে না। এ জালকে চায়না জাল, ম্যাজিক জাল এবং ঢলুক জাল নামেও ডাকা হয়। জালের মেস-সাইজের চেয়ে কম হলে, সেটি দেশের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। এ কারণে বাংলাদেশে কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ করা হয়। ঠিক একই কারণে চায়না দুয়ারীও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে এ জাল। প্রস্থ হবে এক থেকে দেড় ফুট, আর এর গিঁঠ হবে খুবই ক্ষুদ্র। লোহার চারকোনা রড দিয়ে অনেকগুলো ফ্রেম বানানো হয় জালের মধ্যে দেওয়ার জন্য। প্রয়োজন অনুসারে জালের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী রডের ফ্রেমের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এটি নদীর একেবারে তলদেশ পর্যন্ত যায় এবং তলদেশের মাটির সাথে মিশে থাকে। ফলে কোন মাছ একবার জালে ঢুকলে আর বের হতে পারে না।
ঝালকাঠির গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের চর ভাটারাকান্দা গ্রামের বিষখালী নদী তীর এলাকার বাসিন্দা মো. আল আমিন বলেন, সকালে প্রতিদিনই জেলেরা চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ ধরে। জালে সব ধরণের মাছ আটকা পড়ে। এই জাল যে নিষিদ্ধ তা আমরা জানি না। মাছ ধরা শেষে জেলেরা ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে জালগুলো শুকায়। এ জাল সম্পর্কে স্থানীয়দের কোন ধারণা না থাকায় খোলা জায়গায় রাখলেও কেউ কিছু বলে না।
নদী তীরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, আগে জেলেদের দেখতাম কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরতে, এখন দেখি চায়না দুয়ারি দিয়ে মাছ ধরে। কারেন্ট জালের চেয়েও বেশি মাছ পাওয়া যায় এই জালে। এতে গুড়া মাছও বাদ যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে বলেন, আমরা জানি কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ, কিন্তু চায়না দুয়ারি নিষিদ্ধ না। আমরা এটা সব সময়ই ব্যবহার করি। নদীতে ফেলে অনেক দিন ধরে মাছ ধরছি, প্রশাসন কিংবা মৎস্য বিভাগ থেকেও আমাদের কেউ নিষেধ করেনি।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম মাসুম বলেন, চায়না দুয়ারি জাল আমার ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে কেউ শুকায়নি। আমরা বিভিন্ন সময় খবর পেয়ে এগুলো জেলেদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি। ইউএনও ম্যাডাম এসে জালগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ ধরার খবর আমাদের কাছে নেই। তবে শুনেছি গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নে কিছু জেলেরা এ জাল ব্যবহার শুরু করেছেন। আমাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন নাহার ইউনিয়ন পরিষদের মাঠ থেকে জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেয়। এ জাল যাতে জেলেরা ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এইচকেআর
