কুয়াকাটায় প্রতিদিন ছয় হাজার লাল কাঁকড়ার মৃত্যু বন্ধ হোক


১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সৈকত বিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত।
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্য কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্র সৈকতটি এখন জনপ্রিয় একটি পর্যটনকেন্দ্রও।
এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখার সৌন্দর্য ! খুব সহজেই উপভোগ করা যায় এখানে। বিশ্বের অন্যতম এই সমুদ্র সৈকতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ সহ বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রায় মাছ।
কিন্তু এখানকার এক শ্রেণীর লোভী ও বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালক এবং অসচেতন পর্যটকদের কারণে সৌন্দর্যকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জীববৈচিত্রে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কেননা, পর্যটন মৌসুমে এখানকার প্রায় দুইশতাধিক মোটরসাইকেল চালকের নিরবিচ্ছিন্ন ও বেপরোয়া চলাচলের জন্য চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রতিদিন অন্তত ছয়হাজার কাঁঁকড়ার মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু, মাত্র তো বছর কয়েক আগেও দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পরিযায়ি পর্যটকরা কুয়াকাটার বিভিন্ন সৈকতে গিয়ে দেখতে পেতেন টকটকে লাল ঝাঁকবাঁধা কাঁকড়া দৃশ্য।
তখন মনে হতো সৈকতরাজ্যে বেড়াতে আসা অতিথিদের লালগালিচা সংবর্ধনায় সম্মান ও আনন্দ দিচ্ছে সৌন্দর্যের প্রতীক প্রাকৃতিক জীব লাল কাঁকড়ার দল।
গতকাল দৈনিক মতবাদের অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুয়াকাটার প্রত্যেক বাইক বাহক দিনে অন্তত দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন সৈকতে যাতায়ত করে।
তাই, এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিবার একটি মোটরসাইকেলের ট্রিপে অন্তত ১০টি করে কাঁকড়ার মৃত্যু হয়।
এভাবেই হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, বাইক চাপায় কুয়াকাটার অন্যতম লাল কাঁকড়ার চরসহ, কাউয়ার চর, চর গঙ্গামতী, ঝিনুক বীচ এবং লেবুর চর সৈকতে প্রতিদিন গড়ে ছয়হাজার অনিন্দ্য সুন্দর লাল কাঁকড়ার মৃত্যু হয়।
এতে করে একদিকে সৈকতের সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে মৃত কাঁকড়ার দুর্গন্ধে সৈকতের পরিবেশ দূষণ ঘটছে।
ফলে, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বিখ্যাত লাল কাঁকড়ার চরেও নাকি, এখন আর লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ দৃশ্য যেমন দেখা যায় না।
তেমনি এখন কুয়াকাটা সৈকতের কোনও বালিয়াড়িতেই পূর্বের ন্যায় সৌন্দর্য বর্ধনকারী প্রাকৃতিক সম্পদ লাল কাঁকড়ার দেখা পাওয়া খুবই ভাগ্যের বিষয়। সম্প্রতি কুয়াকাটার লাল কাঁকড়াবিলীনের এমনই এক ভয়াবহ ও দু:খজনক তথ্য উঠে এসেছে সমুদ্র পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন মেরিন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে।
সংগঠনটির প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে যে,...পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত যে ৫০/৬০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন, এদের ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় কতৃপক্ষের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে প্রতিদিন এই সৈকতে পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট জাতীয় ৯০ শতাংশ বর্জ্যই চলে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে।
এর কারণে সমুদ্রের প্রতিবেশ ব্যবস্থা প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের স্বচ্ছ¡তা।
জানা যায়, পৃথিবীর সৃষ্টির প্রথমদিকে আবির্ভূত হওয়া জীবগুলোর মধ্যে কাঁকড়া প্রজাতির প্রাণীগুলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে নয়, এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
যেমন, ফ্লোরিডার সমুদ্র সৈকতের নাল কাঁকড়ার দল প্রায় ৪৪৫ মিলিয়ন বছরের ইতিহাসও প্রত্যক্ষভাবে বয়ে চলেছে।
ফ্লোরিডার নাল কাঁকড়ার ঔষধি গুণে জীবন বাঁচছে লক্ষ লক্ষ মুমূর্ষ রোগীর। বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বের কাঁকড়া নাকি প্রজাতিগত দিক থেকে কাঁকড়ার চেয়ে বিভিন্ন মাকড়শা এবং বৃশ্চিকের সাথে বেশি সম্পর্কযুক্ত এবং সামুদ্রিক কাঁকড়া দেখতেও অনেকটাই বৃশ্চিক সাদৃশ্যপূর্ণ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, লাল কাঁকড়ার মাথায় সর্বমোট নয়টি ছোট ছোট এবং দুইটি বড় চোখ থাকে। চোখগুলো পুরো দেহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্তৃত রয়েছে। তবে এর প্রধান দুটো চোখ মাথার সম্মুখে থাকে যা দ্বারা সে সঙ্গীদের অনুসন্ধান করে থাকে। আর অন্যান্য চোখগুলো সাধারণত আলোর উৎস খুঁজে আপন উচ্ছ্বাসে দ্রত ছোটাছুটি করে চলে।
কয়েক বছর আগেও এই লাল কাঁকড়া যত্রতত্র সৈকতের বালুতে গর্ত করে নিশ্চিন্তে বসবাস করত।
এরা তখন নির্ভয়ে এদিক-সেদিক নিয়মিত বিচরণ করত। সাদা দুটি লম্বা চোখের দন্ড উপরে এন্টেনার মতো লাল দুটি অংশে মেলে দিয়ে সৈকতের এ-প্রন্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সবখানেই এই লাল কাঁকড়ার আধিপত্য ছিল।
তখন অবশ্য এদর সঙ্গে দেখা যেত আরো নানা প্রজাতির ছোট কাঁকড়াও।
কিন্তু, দু:খজনক হলেও সত্যি যে, সৈকত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের ব্যাপক অব্যবস্থাপনা এবং আইন-শৃঙ্খলা বহিনীর কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক বিনিময়ের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের মটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে, বিচের বাইক দৌরাত্ম ও অতিরিক্ত মানুষের পদচারণার কারণে সৈকতের সর্বত্রই লাল কাঁকড়া বিচের স্বাভাবিক সৌন্দর্য এখন বিপন্ন হওয়ার পথে।
কারণ, এই প্রাণীটি খুবই স্পর্শকাতর। মানুষ কাছে গেলেই এগুলো তাদের গড়ে তোলা গর্তে ঢুকে যায়। মানুষের আনাগোনা না থাকলে গর্ত থেকে বের হয়ে সৈকতময় আনন্দে ঘুরে বেড়ায়।
যদিও, কুয়াকাটা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের লোকজন মাঝেমধ্যে পরিবেশ রক্ষার্থের নামে কখনো ডামি অভিযান চালায় কিন্তু তারা চলে গেলে আবার ডিউটিরত ও বীচ দেখভালকারীদের অর্থের বিনিময় ম্যানেজ করে বাইকবাহীনির অসৌজন্য চলাচল চলতেই থাকে।
তাই, কুয়াকাটা সৈকতের লাল কাঁকড়া রক্ষার্থে জনসাধারণ ও মটর বাইকের বেপরোয়া চলাচল অচিরেই বন্ধ করা প্রয়াজন এবং এখানকার সকল সমুদ্র জীববৈচিত্রের চারণভূমি সংরক্ষণের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করাও জরুরি।
একই সাথে নির্দেশনা মূলক সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রকার প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থাও নেয়া দরকার।
সেই সাথে বিচের বালিয়ারিতে ঝুঁকিপূর্ণ সকল প্রকার যান চলাচলে আইন চালু করার পাশাপাশি সৈকত প্রাণীদের চারণভূমি চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ জোন করা হলে কুয়াকাটার সৌন্দর্য ও লাল কাঁকড়ার জীবন রক্ষা পাবে।
এজন্য স্থানীয় সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আর তাতেই হয়তো, অতীতের ন্যায় সৈকতজুড়ে আবার লাল কাঁঁকড়ার অবাধ বিচরণ এবং কুয়াকাটার নৈসর্গিক রূপ আর সাগরের স্বচ্ছ জলের উত্তাল ঢেই উচ্ছ্বল হয়ে উঠবে অবার ।
লেখক : কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।
এইচকেআর
