আষাঢ় যতোই আসুক, প্রকৃতিতে এখনো জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ


বর্ষা আগমনের দিন আজ। পহেলা আষাঢ়ের তোড়জোড় যতোই প্রকট হোক না কেন; জ্যৈষ্ঠের শেষ লগ্নের প্রখড় খড়তাপ কমেনি। হয়তো কালোমেঘে ঢেকেছে আকাশ। মাসের নিরিখে বর্ষার জয়যাত্রা শুরু হবে আজ বুধলবার, আষাঢ়স্য থেকে। বর্ষা তো, বাঙালির যাকে বলে জন্ম রোমান্টিকতা। সেই যে বরাবরই অত্যুৎসাহী আমাদের প্রকৃতি প্রেম...।
আকাশপানে মেঘ জমলেই, বৃষ্টির আগাম সংকেত। মেঘ ও বৃষ্টির অনুষঙ্গ শুনতে পেলেই যেন কৈশোর এসে গলা জড়িয়ে ধরে। আমাদের ছেলেবেলা/ মেয়েবেলা দানা বাঁধে স্মৃতিতে। তাই তো, আষাঢ়ে মেঘের ডাক শুনলেই বাঙালির কাছে সমস্ত কিছুই প্রিয়তর হয়ে ওঠে। বৃষ্টিবিধৌত প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হয় অন্তর।
সমস্ত চরাচর ভিজে উঠলে, মাটির সোঁদা গন্ধে আমরাও কেমন ভিজে উঠি। ভিজে ওঠে ভালবাসা ভরা নিত্য চপলতা। বর্ষা প্রকৃতির আগামী আগমনী নিয়ে আমরা ভাবি বা না-ভাবি, টাপুর-টুপুর আষাঢ়ে বৃষ্টির গানে আর তার ছন্দ উৎসবে বাঙালি মেতেছে, মুখরিত থেকেছে আজীবন।
তবুও এখন অনেকের কাছে বর্ষা আসলেই ভয়-শঙ্কাও জাগে, তাই বর্ষা হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার ঋতু! শহরের বিপজ্জনক কাঠামোয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় বাসিন্দাদের অন্তরেও জমে নানা হতাশার কালোমেঘ।
কারণ, আমাদের সিটি ব্যবস্থাপনায় যে কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের প্রায় সমস্ত রাস্তাঘাট, পুকুর, খাল উপচে উঠবে আমাদের শহুরে জীবনের ভাগাড়। অপরিকল্পিত স্যুয়ারেজে জমা জলের প্লাবন বাড়বে, নিচু এলাকা তলিয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা রয়েছে, তা-ও বহুগুণ বেড়ে যায় বর্ষা এলে। ফলে ভরা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে আমাদের আনন্দ আর শঙ্কা এই দ্বিবিধ অভিজ্ঞতায় টইটুম্বুর হয়, জলজ মেঘ, কিংবা কখনও বৃষ্টির উতলধারায়।
তবে, বৃষ্টি হোক আর না-ই হোক! আজ আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষার পারফরম্যান্স কেমন হবে, কিংবা প্রেমিকার হাত ধরে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের বিশাল মাঠের চারপাশ ঘুরে বেড়ানোর মতোন স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পারফরম্যান্স আষাঢ়ের প্রথম দিনেই ঘটবে কি-না? হয়তো তেমন বার্তা নিয়ে আবহাওয়া দফতরও থাকবে অনিশ্চয়তায়।
তাও বর্ষা নিয়ে যত ‘আহ্লাদ’ই থাকুক না কেন, কালিদাসের ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ প্রবাদসম পংক্তিটুকু ছাড়া পহেলা আষাঢ়ের সঙ্গে বাঙালির যোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। তিথি-লগ্নের হিসেবেও পহেলা আষাঢ়ের বাড়তি তাৎপর্য নেই। “আষাঢ়ের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান হল অম্বুবাচী। সেই অম্বুবাচী যদি পয়লা আষাঢ় পড়ে, তাহলে তারিখ হিসেবে তা গুরুত্বপূর্ণ। না হলে পয়লা আষাঢ় আলাদাভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
আবার আষাঢ় যতোই আমাদের জীবনে এসে জেঁকে বসুক না কেন? প্রকৃতিতে এখনো জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ! জলবায়ু গ্রীষ্মমণ্ডল সংক্রান্ত আপেক্ষিক আর্দ্রতায় জর্জরিত। মোটামুটি ভাবে জলবায়ুকে ব্যাখ্যা করে বললে, পরিমিত উষ্ণ ও বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও মাটির উত্তাপ বিকিরণ মাত্রায় প্রচণ্ড শুষ্ক। দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদের তাপ ও অসহ্য গরম। সন্ধে নামলে কিছুটা স্বস্তি। রাত যেন খানিকটা ঠাণ্ডা। এখন মনে মনে দিন গোণা, কবে বর্ষা পুরোপুরি সক্রিয় হয়েই আসবে।
তা হলেই না, গরমের চোখ রাঙানি স্থিতিশীল হবে। স্বস্তি মিলবে মানুষের। আর তখন তামাম আকাশে শুধুই বৃষ্টি বৃষ্টি গল্পগাছি। টানা প্রায় তিনমাস যাবৎ বৃষ্টি ধারাপাতের শিহরণে ভিজবে আমাদের গ্রাম শহর ও শহরতলি। আমাদের বৃষ্টি সুখের আবেশ মেখে মন ছলাৎ ছল হবে। চাতক পাখির মতো তখন নব্য বর্ষামঙ্গল। হাপিত্যেশ শেষে বারিষণ ঝরতেই মন-যেন নদীর এপার ওপার জল থই থই। প্রকৃতির গাছপালা, মাঠঘাট ক্রমশ সবুজ থেকে সবুজতর হয়ে উঠতে থাকবে। বৃষ্টির গুঁড়ি গুঁড়ি ছিটে মাখা গাছেদের ভেজা পাতা চুঁইয়ে জল ফোঁটা ফোঁটা, মেঘলা বিকেলে মনের কোথাও যেন আলতো ছুঁয়ে যাবে মায়া জড়ানো স্মৃতিসুষমা।
কিন্তু পয়লা আষাঢ় নিয়ে এই স্মৃতি-বিস্মৃতির দিনেও ব্যতিক্রম সেই আদি-অনন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তাই তো, অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষা-আহ্লাদ ছিল। তাতেই তিনি গান বেঁধেছেন, কবিতা লিখেছেন। আষাঢ়ও এসেছে তাঁর নানা লেখায়, কবিতা, চিঠিপত্রে।’’ তাছাড়া অধিকাংশ বাঙালির তো একটু আলগা ছেড়ে দেওয়া মন জুড়ে বর্ষায় নেকুপুষু কবিতা লেখার জন্য এক অমোঘ ছটফটানি থাকেই।
উলুকঝুলুক কবিতা ও সেই সঙ্গে অবুঝ ভালোবাসার অভিমানগুলো একই নৌকায় পারাপার হতেই যেন সেইসব কবির মুখোমুখি বসে কোনও এক বনলতা সেন। বৃষ্টির উচ্ছাসে কবিরাও তখন দারুণ অক্ষর কোলাহলে, সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং চ্যাট বক্সের দৌলতে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, উই চ্যাট, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এ-সবেই জানলা বা ছাদ বা গাছের পাতা চোঁয়ানো বৃষ্টির ছবি আর অজস্র কবিতার খোয়াব ছড়িয়ে দেন।
এছাড়াও, আদপে বৃষ্টি হচ্ছে আমাদের জীবনের কারুকাজ বাঙালির হেঁসেলের উৎসবও। এটা যৌথ পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি-সবখানেই প্রখর বৃষ্টির কোনও কোনও দিন, ছুটির দুপুর বা রাতের খাওয়ার আয়োজনে বিশেষ বর্ষা উদযাপনের ছবিটা কিন্তু একচুলও বদলায়নি আজও। তাই, চাইনিজ কিংবা পিৎজা হাট, ম্যাকডোনাল্ড, কন্টিনেন্টালের যুগে এসে, এখনও বর্ষায় ‘খিচুরির’ আবেগ ভুলতে পারেন না কোনও বাঙালিই। সেইসাথে বরাবরই বর্ষার সঙ্গে খুবই একনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির হেঁসেলে নিজস্ব রন্ধন মৌতাত। তাই তো, ভোজনরসিক মাত্রই অনেকেই বেশ তৃপ্তিবোধ করেন ভরা বর্ষার দিনে জম্পেশ করে খাওয়া-দাওয়ায়।
ফলে, বর্ষার দিনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, বাজার থেকে কিনে আনা ডিমভরা ইলিশ মাছ। তারপর ছাঁকা তেলে ইলিশ মাছের ডিমের বড়া আর চাক পিস ইলিশের কডকড়ে ভাজা, সঙ্গে বেগুনি, পেঁয়াজুর স্বাদ, কুমড়ো ভাজা, পটল ভাজা, তোপসে ফ্রাই, ইলিশ মাছের ডিম ভাজা আর হাঁসের ডিমের অমলেট- উফ! এ সবই তো, বাঙালির রসনায় সেই আদি ও অকৃত্রিম সোয়াদের আনন্দে জমে ওঠে আমাদের বৃষ্টবিলাস!
তাহলে কি? ধরেই নেব, আজ আষাঢ়ের আমন্ত্রণে এ-শহরের আকাশ জুড়ে বইবে বৃষ্টির উতলধারা! বরিশালের গোটা আকাশটাও কী, আজ তাহলে, মৌসুমি বায়ুর খপ্পরে ছিনতাই হবে? নবগ্রাম রোড কিংবা বিবিরপুকুরের ঘাট বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় ধুয়ে যাবে নিরুচ্চার। কতই না বিচিত্র কলধ্বনি বইবে সেই ধারাপাতে, প্রতি পলে পলে খোলতাই হবে প্রকৃতি রূপ। বৃষ্টিপতনের আশ্চর্য সংগীত ধ্বনিত হবে বর্ষামঙ্গলের সুরে বর্ষার বৃষ্টিগান।
বর্ষার টাপুরটুপুর দিনে বৃষ্টিরগান শোনার একটা অন্যরকম মোহমায়া আছে। আর বর্ষার সঙ্গে বাঙালি মনের মিতালি যেন মেঘমল্লারের সুর লাগে আমাদের মনে। নিবিড় সেই বিশুদ্ধ পরিবহ মন যেন কীর্তনখোলার এপার ওপার জলে থই থই হয়,। আজন্মলালিত প্রেমিক- হৃদয়।
লেখক: কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।
এসএমএইচ
