ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

একে একে মিলল ২৯ লাশ, নিখোঁজ অনেকে

একে একে মিলল ২৯ লাশ, নিখোঁজ অনেকে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন


স্বজনদের গগন বিদারী কান্না-আহাজারি আর শ্বাসরুদ্ধর ১৯ ঘণ্টার উদ্ধার অভিযান শেষে শীতলক্ষ্যায় জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী লঞ্চটি উদ্ধার করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়। রবিবার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশু ও নারীসহ মোট ২৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।


জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী দুর্ঘটনায় মোট নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। তবে ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে ৪৬ জন যাত্রী ছিল বলে যে তথ্য বিআইডব্লিউটিএ ও লঞ্চ মালিক সমিতির তরফ থেকে দেয়া হয়েছিল সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করেছেন কয়েকজন বেঁচে যাওয়া যাত্রী।

তাদের ভাষ্য মতে, লঞ্চটিতে শিশুসহ একশোর কাছাকাছি যাত্রী ছিল। যদিও সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী ছোট্ট ওই লঞ্চটিতে এত সংখ্যক যাত্রী উঠানো ছিল আইন পরিপন্থী।

এদিকে যাত্রীবাহী লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়া সেই কোস্টার জাহাজটিকে এখনও পর্যন্ত আটক বা এর সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ।

এদিকে সোমবার বিকাল ৫টার দিকে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, বৈরি আবহাওয়ার জন্য রোববার রাতে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হলেও সোমবার ভোর থেকে অভিযান চলে পুরো দমে।

তিনি সোমবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, সর্বশেষ ২৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বেশির ভাগ লাশের স্বজনরাই পাশের জেলা মুন্সিগঞ্জের। প্রতি লাশের স্বজনদের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে এবং লাশ পরিবহনের জন্য সহায়তা করা হচ্ছে।

এদিকে উদ্ধার অভিযান সরকারীভাবে শেষ হলেও স্থানীয় পর্যায়ে নিখোঁজের স্বজনরা সেখানে ট্রলার, নৌকা নিয়ে অভিযান চালাতে থাকেন। আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার দিয়েও বিকাল থেকে ঘটনাস্থল ও আশপাশে টহল দিতে দেখা গেছে।
 
জেলা প্রশাসনের তালিকায় মোট ৩৫ জন নিখোঁজ যাত্রীর তালিকা ছিল বলে জানা গেছে। তার মধ্যে ২৯টি লাশ উদ্ধার ও শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা হলেন- মুন্সিগঞ্জ সদরের নুড়াইতলী এলাকার মুখলেছের মেয়ে রুনা আক্তার (২৪), মোল্লাকান্দি চৌদ্দমোড়া এলাকার সমর আলী বেপারীর পুত্র সোলেমান বেপারী (৬০) ও তার স্ত্রী বেবী বেগম (৫৫), মালপাড়া এলাকার হারাধন সাহার স্ত্রী সুনিতা সাহা (৪০), তার ছেলে পুত্র বিকাশ সাহা (২২), উত্তর চর মসুরা এলাকার অলিউল্লাহর স্ত্রী পখিনা (৪৫), একই এলাকার আরিফের স্ত্রী বিথি (১৮) ও তার মেয়ে আরিফা (১), মুন্সিগঞ্জ সদরের প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫০), মোল্লাকান্দি চর কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন (৯০) ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), উজিরপুরের খায়রুল হাওলাদারের পুত্র হাফিজুর রহমান (২৪) এবং তার স্ত্রী তাহমিনা (২০) ও পুত্র আব্দুলাহ (১), দক্ষিণ কেওয়ার দেবীন্দ্র চন্দ্র দাসের পুত্র নারায়ণ দাস (৬৫) ও তার স্ত্রী পার্বতী রানী দাস (৪৫), বন্দরের কামরুজ্জামানের শিশু পুত্র আজমীর (২),  মুন্সিগঞ্জ সদরের রিকাবিবাজার নূরপুর এলাকার মুশকে আলম মৃধার পুত্র শাহআলম মৃধা (৫৫), রতন পাতরের স্ত্রী মহারানী (৩৭), ঢাকার শনিরআখড়া এলাকার রশিদ হাওলাদারের পুত্র আনোয়ার হোসেন (৪৫), তার স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০), মাকসুদার মেয়ে মানসুরা (৭), নোয়াগাঁও পূর্বপাড়া এলাকার মিঠুনের স্ত্রী ছাউদা আক্তার লতা (১৮), লতার ছোট বোন সাদিয়া (১১), নড়িয়া শরিয়তপুর জেলার মৃত নুরনবী শেখের ছেলে আব্দুল খালেক (৭০), বরিশালের স্বরুপকাঠি এলাকার খাদিজা বেগম (৫০), ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া এলাকার জিবু (১৩), বন্দরের সেলসারদী এলাকার নুরু মিয়ার ছেলে মো. নয়ন (২৯) এবং দোলা বেগম (৩৪)।

এর মধ্যে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন মৃত সুনিতা সাহার অপর ছেলে অনিক সাহা (১২), মধ্য কোন্ডাগাও এলাকার মতিউর রহমান কাজীর পুত্র ইউসুফ কাজী, ঢাকা মিরপুর-১১ এর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের পুত্র মো. সোহাগ হাওলাদার, টঙ্গীবাড়ি বেতকা এলাকার মুছা শেখের পুত্র জাকির হোসেন (৪৫), মৃত আনোয়ার, মুন্সিগঞ্জ সদরের দক্ষিণ ইসলামপুরের মো. নুরুল আমিনের পুত্র মো. তানভীর হোসেন হৃদয়, মালপাড়া এলাকার সিরাজের পুত্র রিজভী (২০)।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয় বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী দল। দুপুর ২টার দিকে লঞ্চটি উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ এর ক্রেনের সাহায্যে উপরে তুলতেই মিলতে থাকে একের পর এক লাশ।

এ সময় নদীর তীরে থাকা অপেক্ষমাণ স্বজনদের চিৎকার আর বুক ফাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। একের পর এক লাশ তুলে আনার সেই দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেন প্রশাসন, এলাকার লোক ও গণমাধ্যম কর্মীরাও। লাশ সনাক্তের জন্য স্বজনরা এসময় ছুটে যান উদ্ধারকারী জাহাজের সামনে।

কিছুটা বিকৃত হওয়ায় অনেক লাশ নিয়ে স্বজনেরা নিজেদের বলেও দাবী করতে থাকেন। স্বজনদের পাশাপাশি স্থানীয় শত শত মানুষের আগমনের কারণে সেখানে উদ্ধারকাজ  ও লাশ সনাক্ত করতে  বেশ বেগ পেতে হয় প্রশাসনকে।

এদিকে লঞ্চডুবিতে নিহত মাকসুদা আক্তারের লাশটি পাওয়া যায় তার মেয়ে মানসুরাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায়। সেই দৃশ্য দেখে ঘটনাস্থলেই কেঁদে ফেলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা। রোববার ভোর রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে উদ্ধারকাজ তদারকি করছিলেন। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি এ সময় নিস্তব্ধ হয়ে পরেন।

অপরদিকে লঞ্চ ডুবির ঘটনায় বেঁচে আসা বন্দর এলাকার সাইফুল জানান, লঞ্চটিতে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা সর্বসাকুল্যে ৫০ জন। সেখানে লঞ্চটিতে যাত্রী নেয়া হয়েছিল কমপক্ষে ৭০-৮০ জনের মতো। মূলত যারা লঞ্চের ছাদে ছিলেন তারাই ধাক্কা লাগার সাঁতরিয়ে তীরে উঠেছেন। কেউ কেউ নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা সেতুর পিলার ধরে রক্ষা পেয়েছেন। যারা লঞ্চের ভিতরে ছিলেন, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা কিছু বুঝে উঠার আগেই লঞ্চটি তলিয়ে যায়।

ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের নিরাপত্তকর্মী মোহাম্মদ হালিম  বলেন, রোববার সন্ধ্যার কিছু আগে এসকেএল-৩ নামের একটি কোস্টার জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে অন্তত ২০০ মিটার লঞ্চটিকে টেনে নিয়ে যায়। এরপর লঞ্চটি যাত্রীসহ ডুবে যায়। আশপাশে কোনো নৌকা না থাকায় অনেকেই রক্ষা পাননি।

হালিম জানান, লঞ্চটি এবং কোস্টার জাহাজটি পাশাপাশি অবস্থান করছিল। মানুষের চিৎকার শুনে আমরা সেদিকে তাকিয়ে এই দুর্ঘটনা দেখি।
 
কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববিকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ।

অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর নৌ ট্রাফিক পুলিশের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যের অপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


এমবি
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন