আজ বিশ্ব জন্মগত-ত্রুটি দিবস


৩ মার্চ, আজ‘বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস’। এই দিবসটি ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও অনেক শিশুই জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে শতকরা কতজন শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
অন্যদিকে সবাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ১০০ শিশুর তিন থেকে ছয় জন বড় ধরনের জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় প্রতিবছর আট মিলিয়ন বাচ্চার ছয় ভাগ মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে তিন দশমিক তিন মিলিয়ন শিশু জন্মানোর পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়।
শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা যায় এ কারণে এবং তিন দশমিক দুই মিলিয়ন শিশু, যারা মৃত্যুর ছোবল থেকে বেঁচে যায়, তারা আজন্ম শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে দিন কাটায়।
২০১৬ সালের ৩ মার্চ ‘বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস’উপলক্ষে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি ১০ জনে একের অধিক নবজাতক শিশু জন্মগত ত্রুটিজনিত কারণে মারা যায়। সাধারণত জন্মের সময় যদি শিশুর দেহের কোনো অঙ্গ অনুপস্থিত বা ত্রুটিপূর্ণ থাকে, তাহলে তাকে জন্মগত ত্রুটি বলে।
এটি শরীরের গঠনগত, কার্যগত, মেটাবলিক বা জেনেটিক অসামঞ্জস্য যা ভ্রূণ অবস্থাতেই উৎপন্ন হয়। জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই। বেশির ভাগ সময়ে মাকেই শিশুর জন্মগত ত্রুটির জন্য দোষারোপ করা হয়। অনেকে এর কারণ হিসেবে গর্ভকালীন সূর্যগ্রহণ/চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব, খাবার খাওয়ার ফল, মানুষের কুনজর, জিন-পরির আসরকে দায়ী মনে করে।
তবে এখন পর্যন্ত জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে যেসব কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বংশগত, জিনগত, রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ, খুব কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, গর্ভকালীন ধূমপান ও মদ্যপান, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, খিঁচুনি, অপচিকিৎসা, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত জন্মনিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ সেবন ইত্যাদি।
এছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, জন্মগত ত্রুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কিন্তু এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়। পৃথিবীতে প্রায় চার হাজারের বেশি রকমের জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৩ শিশুর একজন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মায়েদের পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য, আত্মীয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক, জিনগত ও বংশানুক্রমিক রোগের কারণগুলো দায়ী করা হয়। (সূত্র : মার্চ অব ডাইম)
জন্মগত ত্রুটিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কাঠামোগত জন্ম ত্রুটি (Structural Birth Defect), অর্থাৎ কোন অঙ্গ জন্ম থেকেই অস্বাভাবিক, অকেজো, অসম্পূর্ণ। যেমন : হৃৎপিণ্ডের সমস্যা। অন্যটি হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় অকার্যকারিতা (Functional Birth Defect)। এ কারণে যেসব জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে তা হলো, খাদ্যরস পাচিত না হওয়ার কারণে বিপাকীয় সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তির অনুন্নতি, বধির, দৃষ্টিস্বল্পতা ইত্যাদি।
গবেষণায় এও দেখা গেছে, ছেলেশিশুদের জন্মগত ত্রুটির সংখ্যা মেয়েশিশুদের তুলনায় বেশি। যেমন পাঁচ হাজার ৫৯৮ শিশুর মধ্যে তিন হাজার ৮৩৭ জন ছেলে এবং এক হাজার ৭৬১ জন মেয়ে। অর্থাৎ ছেলে : মেয়ে-২.১ : ১। মৃত্যুর হিসাব করলে দেখা গেছে, তিন হাজার ৯২১ জন জন্মগত ত্রুটি শিশুর সার্জারি করা হয়েছিল এবং ২২৫ শিশু গবেষণা চলাকালেই মৃত্যুবরণ করেছিল।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, প্রতি ২০ হাজার কন্যাশিশুর মধ্যে একজন এ ধরনের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। যাদের মূত্রনালি, ঋতুস্রাবের রাস্তা এবং মলদ্বার একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি ছিদ্র দিয়ে বের হয়। এই দুর্লভ প্রকারটি কখনো কোনো পুরুষ শিশুর শরীরে চিহ্নিত হয়নি।
জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও কারণগুলো অনুসন্ধান ও প্রতিকারের মাধ্যমে শিশুদের স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ ও গবেষণার সুযোগ তৈরির জন্য সারা বিশ্বের সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি সুস্থ, স্বাভাবিক শিশুর জন্ম নিশ্চিত করার আশঙ্কা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে সবার এগিয়ে আসা উচিত।
এজন্য গর্ভধারণের আগেই মা-বাবার পূর্ব ইতিহাস জেনে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ভ্রূণের প্রথম ১২ থেকে ২২ সপ্তাহে ‘হাই রেজল্যুশন আল্ট্রাসনোগ্রামের’ মাধ্যমে বেশির ভাগ ত্রুটি বোঝা যেতে পারে। তাই এই সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করানো উচিত। এ ছাড়া জিনগত সমস্যা শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা এবং ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড অ্যানালাইসিস’, ‘কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পল অ্যানালাইসিস’ ইত্যাদি এখন বাংলাদেশেই সম্ভব।
এসএম
