ঢাকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

Motobad news
মন্তব্য প্রতিবেদন...

মেয়রের উদ্যোগেই স্বরূপে ফিরছে অশ্বিনীকুমার হল

মেয়রের উদ্যোগেই স্বরূপে ফিরছে অশ্বিনীকুমার হল
সংস্কার হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী অশ্বিনী কুমার হল
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

“হোর্ডিং বোর্ডে ঢেকে যাচ্ছে আইকন অশ্বিনীকুমার হলের মুখ” এই শিরোনামে দৈনিক মতবাদে লেখা একটি মন্তব্য প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে, ঐতিহ্যবাহী অশ্বিনীকুমার হলের সামনে থেকে তোষণ হোর্ডিং বোর্ডগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং দ্রুতই হলটির মেরামত কাজ শেষ করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন মাননীয় মেয়র। এবার নির্দিধায় বলা যায়, মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর উদ্যোগেই ফের স্বরূপে ফিরছে অশ্বিনীকুমার হল।

আর এতেই প্রমাণিত হয় যে, অতীতের যেকোনও মেয়রের চাইতে- বরিশালকে পুরোপুরি স্বপ্নের নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক। তাই তো, ইতোমধ্যেই তার ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিসিসি’র নিজস্ব অর্থায়নে সাধিত- বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বরিশালবাসীর কাছে উদাহরণ হয়ে উঠছে।

যদিও মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। তবুও সেই প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন ও আকাংখা বাস্তবায়নে, মেয়র সাদিক নিয়তই জনগণের জন্য কাজ করে চলেছেন। কেননা, আমরা অন্তত এ-ও জানি যে, এই শহরের অভিভাবক হিসেবে বরিশালের দর্শনীয় প্রতিটি স্থান ও স্থাপনার গুরুত্বও তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন। কেননা, আমরা জানি, ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষাকারী বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত দেশ আমেরিকায় দীর্ঘদিন বসবাস করার ফলেই, এমন আরো অনেক অভিজ্ঞতা ও মুগ্ধ ভালোবাসাবোধে উজ্জীবিত ও সন্নিবেশিত হয়েছে তার অন্তর। আবার, পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতায় তিনি এ-ও বুঝেছেন যে, ঐতিহ্য রক্ষা ছাড়া কোনো আধুনিকতাই শতভাগ সম্পূর্ণ হয় না।

পক্ষান্তরে, একটি জাতীর ঐতিহাসিক মূল্যবোধ বরাবরই অতীতের সাথে বর্তমানের অকাট্য সংযোগ ঘটিয়ে দেয় বলেইÑ আমাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারা প্রত্যেক আধুনিক সমাজের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমরা তো এ-ও জানি, ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে প্যারিস, পর্তুগাল, স্পেন, রোম এ-রকম আরও বহুদেশ বিশ্বের দরবারে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ফলে সভ্যতা ও ঐতিহ্যসংস্কৃতিকে পরম যত্নে আগলে ধরে আমাদের বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ আগামী প্রজন্মের জন্য নানা কারণেই ইতিবাচক আইডল হয়ে উঠছেন।

অশ্বিনীকুমার হল হচ্ছে, বরিশালবাসীর জাগ্রত চেতনার প্রতীক। শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে ওঠা এই হলটি ব্রিটিশ শাসনামল থেকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই হল নির্মাণের আগে বরিশালের সকল সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে। টাউন হল চৌহদ্দির ট্রাস্টি দলিলের বর্ণনায় জানা যায়, এই রাজা বাহাদুর হাবেলি ছিল, বর্তমান কাঠপট্টি রোডের দক্ষিণে এবং চকবাজার রোডের পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই হাবেলিতে রাজনৈতিক মিছিলের ওপর প্রকাশ্যে ব্যাপক পুলিশী হামলা হয়। সেই রক্তাক্ত স্মৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, তখনকার পরাধীন ভারতবর্ষ মুক্তিসংগ্রামের এখানকার যারা অগ্রগণ্য নেতা ছিলেন, তারা তখন এক সভায় মিলিত হয়ে, কোনও নির্দিষ্ট স্থানে- বরিশালের জনগণের চিরস্থায়ি সভা-সমাবেশের জন্য একটি হল নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

তখনকার সেই বিপ্লবীদের অন্যতম অশ্বিনীকুমারকে সভাপতি ও শরৎচন্দ্র গুহকে সম্পাদক করে ১৯২০-সালে হলের জন্য জমি ক্রয় করে, এই হলের কাজ আরম্ভ হয় এবং ১৯৩০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। যদিও, নির্মাণ উদ্যোগের দুইবছরের মধ্যে অশ্বিনী দত্তের (১৯২৩ সালের ৭-নভেম্বর) মৃত্যু হয়। তখন হল নির্মাণ কমিটি ও নাগরবাসির আন্তরিকতায় অশ্বিনী দত্তের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এই মিলনায়তনের নাম ‘অশ্বিনীকুমার হল’ নামকরণ করা হয়। বলা যায়, নির্মাণকাল থেকেই হলটি শহরের সাহিত্য-সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সমাবেশের তীর্থভূমি ও সংস্কৃতি কর্মীদের আড্ডাস্থল হিসেবে দুদণ্ড শান্তিরস্থান হয়ে ওঠে।

তবে একটা সময় ছিল, চাইলেই এই হলে যেকোনো অনুষ্ঠান করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, এর ট্রাস্টি দলিলে লিখিত ‘নির্দোষ আমোদ ও প্রমোদ অনুষ্ঠান’ শব্দটিকে তৎকালীন ‘টাউন কমিটি’ বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতো। অবশ্য এক তথ্য মতে এ-ও জানা যায়, এই হলের অভ্যন্তরে কখনো সিনেমা প্রদর্শন শুরু হলে, তার প্রতিবাদ করে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা শরৎকুমার ঘোষ এই হলের শালিণতা রক্ষার জন্য অনশনব্রত পালন করেছিলেন। আবার বায়ান্নোয় ভাষা অন্দোলনে এখানকার ভাষাসৈনিকদের উদ্যোগে একুশের শহীদদের স্মরণে বরিশালের সর্বপ্রথম নির্মিত স্মৃতির মিনারটি অশ্বিনীকুমার হলের সামনেই তৈরি করা হয়েছিল।

যদিও মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে ২৭-ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া সরকারের নির্দেশে হলের সামনে নির্মিত শহীদ মিনারটি রাতের আঁধারে পুলিশ-আর্মিরা ভেঙে ফেলে। আবার ১৯৬২-সালে তৎকালীন বিহারী জেলা প্রশাসক নির্লজ্জভাবে এই হলটির নাম আইউব খান টাউন হল (এ.কে হল) এবং হলের প্রবেশ মুখের দুইপাশের দুইগেটের একটিতে মিল্লাত ও অন্যটিতে কায়েদে আজম নাম লিখে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলে, তখনও বরিশালের স্থানীয় সচেতন নাগরিকবৃন্দ ও সাংস্কৃতিককর্মীরা আন্দোলন করে ঘৃণ্য সেই ষড়যন্ত্রও রুখে দিয়েছিলেন। ফলে, এই হলের চত্বর জুড়ে নানা আন্দোলন সংগ্রাম বিজড়িত গৌরবময় ভূমিকাও রয়েছে।

আথচ, হলটি ইতিহাস ঐতিহ্যের এতো ধারক সত্বেও, এটির প্রতি পূর্বের প্রত্যেক নগর প্রধানের ঔদাসীণ্যতা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতাও ছিল। ইটের গাঁথুনি ও রড সুরকীর পিলারিং কাঠামোয় দ্বিতলবিশিষ্ট অশ্বিনী হলের কাঠামোটি তৎকালীন ব্রিটিশ বাঁধামঞ্চ বা প্রসেনিয়ম থিয়েটার হলের আর্কিওলজিতে তৈরি হলেও, কালের পরিক্রমায়Ñ বয়সের প্রাচীনত্বে হলের দেয়ালের প্লাস্টারে নোনাক্রান্ত হয়ে ক্ষয় ধরেছে। ভেতরের পিলারগুলোও ভয়ানক ফাটলে ঝুঁকির্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলে হলটিতে অনুষ্ঠান চলাকালীন যে কোনও সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার  হাত থেকে রক্ষা করতে, বর্তমান বিসিসি মেয়রের বিশেষ নির্দেশনায় অনেক আগেই হলটির ঐতিহ্য রক্ষায়, ব্যাপক সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কিন্তু বিষাদময় করোনার অভিঘাতে প্রায় দুবছর যাবৎ বিসিসি’র সংস্কার কাজও যেনো করোনা আক্রান্ত হয়ে যায়। ফলে, দীর্ঘদিন হল সংস্কার অনিশ্চয়তায় ঝিমিয়ে পড়ে বরিশালের বিভিন্ন সংঘ-সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। হলের কোনো কর্মকাণ্ড না থাকায় হল চত্বর ঘিরে একপ্রকার কারপার্কিং গ্যারেজে হয়ে ওঠে এবং কিছু তোষণ হোর্ডিং বোর্ডে ঢেকে ফেলা হয় ঐতিহ্যের স্মারক অশ্বিনীকুমার হলের মুখ। সম্প্রতি হলটির এমোন দু:সময়ের প্রতিবেদন পড়ে বিসিসির মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর আন্তরিক উদ্যোগে তোলা হয়েছে সকল হোর্ডিং বোর্ড এবং পুরোদমে হলটির সংস্কার কাজও শুরু হয়েছে । ফলে ফের অচিরেই ঐতিহ্যের স্বরূপ ফিরে পাচ্ছে, বরিশালের শতবর্ষীয় বিপ্লব-বিক্ষোভের ঐতিহাসিক অশ্বিনীকুমার হল।


লেখক : কবি ও যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক মতবাদ


কে আর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন