ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসি দিবস 

মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসি দিবস 
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে কিছুদূর এগোলেই প্রায় ১০ ফুট উঁচু একটি দেয়াল। ধূসর দেয়ালে মাস্টার দা সূর্যসেনের রঙিন প্রতিকৃতি। দেয়ালের সামনেই সাদা রং করা ফাঁসির মঞ্চ। বেদিটা ঢেকে রাখা হয়েছে টিন দিয়ে। মঞ্চের পাশেই একটা স্মৃতিফলক। সেখানে লেখা আছে, ‘সংরক্ষিত ঐতিহাসিক নিদর্শন: ১৯৩৪ সনে কার্যকর, মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসির মঞ্চ।’


 ১৯৪৩ সালের আজকের দিনে (১২ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ফাঁসির মঞ্চে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী মাস্টার দা সূর্যসেন ও তাঁর সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। এরপর গত ৮৪ বছরে এখানে আর কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন ফাঁসির মঞ্চ। 


চট্টগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্মৃতিবিজড়িত এই ফাঁসির মঞ্চ ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করছে কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। ইতিহাসবিদেরা জানান, ফাঁসি কার্যকরের পর ব্রিটিশ শাসকেরা মাস্টার দা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহের সঙ্গে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়। 


সে কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়কদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেবল টিকে আছে এই ফাঁসির মঞ্চ। কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ফাঁসির মঞ্চের পেছনের দেয়ালে সূর্যসেনের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হলেও তাঁর সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত কারাগারের কনডেম সেলটিও। ঐতিহাসিক নথি ঘেঁটে দেখা যায়, আলীপুর কারাগার থেকে আসা কয়েদি শিবু রাগাদি জল্লাদ হিসেবে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসি কার্যকর করেন। 


ফাঁসির পর বিপ্লবীদের লাশ তাঁদের স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়নি। ১৯৩৩ সালে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা হয়েছিল বিপ্লবীদের। এই ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ছিলেন ডব্লিউ ম্যাকশ। 


রায়বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ ও খন্দকার আলী তৈয়ব ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন। রায়ের আদেশে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড ও কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 


চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন সূর্যকুমার সেন। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। রাজমণি সেন ও শশীবালা সেনের চতুর্থ সন্তান তিনি। ডাকনাম কালু। বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার কাছে। এরপর নোয়াপাড়া দয়াময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া মাইনর স্কুল, চট্টগ্রামের নন্দনকাননের ন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। 


এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে আইএতে ভর্তি হন। এখানেই যুক্ত হন বৈপ্লবিক সংগঠন ‘অনুশীলন’-এর সঙ্গে। আইএ পাস করে চলে যান পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে। ১৯১৮ সালে বিএ পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে এসে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ কারণেই তাঁকে মাস্টারদা নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। 


বহরমপুর থেকে ফিরে এসে সূর্যসেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিবদমান দল দুটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আয়োজিত সভায় সূর্যসেন তাঁর বক্তৃতায় ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা যোগ দেন সশস্ত্র বিদ্রোহে। তাঁর নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগৃহীত হয়। 


সূর্যসেন পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। তিনি দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে বিপ্লবী দল চট্টগ্রামে গিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করবে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল সংঘটিত এ যুদ্ধে ১৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন। সূর্যসেনকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। 


সরকার ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শুরু করে। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার  উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। 

কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনার পরে মাস্টারদা পটিয়ার কাছে গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের সূর্যসেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গোর্খা সৈন্যরা স্থানটি ঘিরে ফেলে। 


সূর্যসেন ধরা পড়েন। ১৯৩৩ সালে সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়।
 


ইতিহাসের এই দিনে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন