ঢাকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

Motobad news

শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা

শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

সাদিয়া কারিমুন:

একটি দেশের বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতর অর্থনীতির চাকা ঘোরে পুরোটাই শ্রমকে ঘিরে, আর শ্রম হচ্ছে  শ্রমিকের ছোঁয়া। আর শ্রমিকের অবদান হল উৎপাদন এবং অর্গযাত্রার মূল চালিকাশক্তি। শ্রম আইনের ধারা ২(৬৫) অনুযায়ী প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনামূলক এবং তদারকি কর্মকর্তা ব্যতিত সবাই শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিক অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গ এলে অধিকারহনন এবং অধিকারহীনতাই বিশ্লেষনের চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিয়মান হয়। আমাদের দেশের শ্রমিকশক্তির সম্পর্কে বিশ্বের দরবারে সবচেয়ে পরিচিত মন্তব্য হল, কম শ্রমিক মূল্যে অধিক লাভ বা মানসম্মত উৎপাদন। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ৫ কোটি ৬৭ লাখ লোক (তথ্যসূত্র- প্রথম আলো)। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে শ্রমিকদের মূল্যায়ন এবং অবদান আলাদা মূল্যায়ন হয়। তবে সে মূল্যায়ন যদি শ্রমিকের ব্যক্তি জীবন এবং কাজের মূল্যায়নে চলমান মানসম্মত জীবনযাত্রা থেকে যুগ যুগ ধরে অসমতার শোষণ আর দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে ফেলে, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরা হারাব অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং দেশকে সমৃদ্ধ করার হাতিয়ার।

আমরা গাভির যত্ন করি, ফলে সে আমাদের দুধ আর গোশত দেয়, বাচ্চা দেয়; এরপর ধীরেধীরে পুরো খামার তৈরী হয়, আয়ের উৎস তৈরী হয়। যদি আমরা খাঁটি দুধ আর গোশত সরবরাহ করি তা ভোক্তাকে সুস্থ রাখতে সহায়ক হবে, স্বাস্থ্যখরচ কমাবে, ভোক্তা চাইলে সেই অব্যবহৃত খরচ থেকে গরীবকে দান করতে পারবে। এরকমভাবে সম্পদের সুষম বন্টন আর মানসম্মত উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত হবে। সে কারণেই আমাদের একটি গরুর আগে দরকার একজন সঠিক পরিচর্যাকারী মালিক। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আওতায়  বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন তেমনই সঠিক মালিকের মত। একেক রাজনৈতিক দলের সংগঠনের একেক রকম কার্যক্রম, মূলত এসব সংগঠনের কাম্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। 

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় জাতীয় শ্রমিক লীগের যাত্রা শুরু হয় শ্রমিকের দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কালের পরিবর্তন হয়েছে উন্নয়নের জোয়ারে, তবে যোগ হয়েছে সাংগঠনিক দায়িত্বশীলতায় ফাঁকাফোকর, স্থবিরতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দলীয় প্রভাব বিস্তার করে পরিবহন খাতে টেন্ডারবাজি ইত্যাদি (তথ্যসূত্র সারাবাংলা, ২০১৯)। এসকল বিভীষিকাময় পরিস্থিতি কি যথেষ্ট নয় এ সংগঠনের কার্যক্রমের ইতিবাচকতায় সন্দিহান করতে? এছাড়াও বিভিন্ন শাখা কমিটিগুলোতে প্রায় ১০-২০ বছর একাধারে দায়িত্ব পালন করায় সংগঠনটির প্রানচাঞ্চল্য হারাচ্ছে। স্বাধীনতার পরে শ্রমিকদলের কার্যক্রমের অগ্রগতি আটকে থেকে গেছে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে। সেই টানাপোড়েনের একটি হল সঠিক নতৃত্বের অভাব। কখনও কখনও তাদের বিভিন্ন শাখা সম্পাদক বিভিন্ন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতও থাকেন। অন্তত একজন নেতা, যিনি সমাজ বদলাবেন, তাকে অনুসরণীয় হতে হয় বৈকি। তাহলে এসব সংগঠন কি নামেমাত্র দলীয় জায়গা দখল করে রয়েছে? 

বিবিসি (২০১৬) সূত্রমতে কার্যকর শ্রমিক সংগঠন হিসেবে বাম দলগুলোর  শ্রমিক সংগঠনগুলো বরাবরই বাংলাদেশে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে, শুধু শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার্থে নয়, শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল জাতীয় রাজনীতিতেই।  শ্রমিক অধিকারে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের মূল্যবোধ হল শ্রমিকের কল্যান, জীবন মানের উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, শ্রমের মর্যাদা, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মালিক শ্রমিক সুসম্পর্ক ইত্যাদি। এসকল মূল্যবোধের অনেকটাই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ; কিন্তু বাস্তবে অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসবের দৌরাত্ম্য একরকম ¤øান। বিদেশ ফেরত শ্রমিকের লাশ, অন্যায্য মজুরি, বছর বছর শ্রমিক আন্দোলনে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব, অপরিকল্পিত শিল্প ভবন ধ্বসে জীবন নাশ আমাদের নির্বিকার রাখে। শ্রমিক নেতারা এখন মন্ত্রী হন, অতীতেও হয়েছেন৷ তাতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভাগ্য কতটা খুলল, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অনেকটা বায়বীয়। আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের নিরলস পরিশ্রমই বাংলাদেশকে উন্নিত করেছে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালন শুরু হয়। কিন্তু ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি শ্রমিক আন্দোলন মোড় নিয়েছিল রাজনৈতিক ইস্যুতে। 

আজকাল অনেক সময়ই দেখা যায় শ্রমিকরা হুট করে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসে ভাঙচুর করছে, মহাসড়ক থেকে রিকশাওয়ালাদের বিদায় করে তাদের আয়ের উৎসকে হুট করে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে, শিল্পকারখানায় মহিলাদের যৌন হয়রানি, সড়কে অনিয়মকে নিয়মের আওতায় নিয়ে আসতে অনৈতিকতার সংস্কৃতিকে টেনে হিচড়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বহু শ্রমিকের অধিকার হনন করে অদেখা ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা অপ্রাপ্তি শ্রমিকের নিত্য দিনের সমস্যা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের শ্রমিক সংগঠন ‘জাতীয় শ্রমিক জোট' স্বীকার করে যে, তারা আগের মত শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারছেনা। সফল এবং সঠিক আন্দোলনের বদলে শুধুই ব্যর্থতা।

সরকার নানামুখী আয়োজনে শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক শ্রমনীতি প্রণয়ন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নামে দুটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি ইত্যাদি বাস্তবায়নে জোর দিলেও তা শ্রমিক সংগঠনগুলোর আওতাভুক্ত কি কি কর্যক্রমে যুক্ত থাকবে, এমন পরিকল্পনার উদাহরণ কি উল্লখযোগ্য? বিভিন্ন আইন এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে যদি জুড়ে না দেওয়া যায় তবে শ্রমিক অধিকার কখনওই প্রতিষ্ঠিত হবেনা বরং  উচ্চ জিডিপি, রপ্তানি আয় নিয়ে সন্তুষ্ট হবার অক্লান্ত ধারাবাহিকতায় শোষণের সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে।


লেখক: সাদিয়া কারিমুন, শিক্ষার্থী, লোক প্রসাশন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
 


/ইই
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন