ঢাকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

Motobad news

শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত অধিকার

শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত অধিকার
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

বাহাউদ্দিন আবির:

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশে ১ লা মে জাতীয় ছুটির দিন। কিন্তু এই ছুটি শ্রমিকরা কতজন উপভোগ করতে পারছে আর কতজন নিজের জীবিকার তাগিদে এইদিনেও শ্রমবাজারে নিজের শ্রম দিয়ে যাচ্ছে আমাদের তা নিয়ে ভাবতে হবে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের  শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা যে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল সেদিনের সে জমায়েতে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। শ্রমিকের রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমেই আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের চেতনা শুরুই হয়েছে এই আন্দোলন থেকে। দীর্ঘ অনিয়ম,স্বেচ্ছাচারিতা আর অনায্যতার মুখে শ্রমিকরা একসময় রুখে দাঁড়ায়। মালিকপক্ষকে জানান দেয় তারাও মানুষ, তাদের ও অধিকার আছে। তাদের ও ছুটি দরকার, নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা দরকার, দরকার নায্য মজুরি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন  প্রতিবছরই বিশ্ব শ্রমিক দিবসে বড় বড় সেমিনার, র‌্যালি, আলোচনা সভা করে শ্রমিক অধিকার, শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে। এ দিবসটি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের চেতনাকে জাগ্রত রাখার দিন। অনেক রাজনৈতিক দল তাদের রাজনীতির চাকা চালায়ই শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলে।


কিন্তু দিনশেষে যেই শ্রমিকদের নিয়ে এত আলোচনা তাদের ভাগ্য আর ফেরে না। আমাদের দেশে শ্রমিক বলতেই সাধারনত গার্মেন্টস বা শিল্পকারখানায় যারা কাজ করে তাদের বুঝায়।। কিন্তু এর পাশাপাশি একটা বড় অংশ আলোচনার বাহিরে রয়ে যায় তা হলো পেশাজীবি শ্রমিক। বিশেষত কারখানা বা শিল্পের শ্রমিকরা উৎপাদনের সাথে জড়িত আর সেবাখাতের শ্রমিকরা ভোক্তা পর্যন্ত তা পৌঁছে দেয়। যেমন নির্মাণ শ্রমিক, বিক্রয় প্রতিনিধি, ড্রাইভার, লোভার সহ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা  শ্রমিকসহ অন্যান্য। আমাদের দেশে শ্রমিক অধিকারের অবস্থা খুবই শোচনীয় পর্যায়ে। তাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পর তা আরো নগ্নভাবে বিশ্ব দরবারেও ফুটে উঠে। এখনো এই দূর্ঘটনায় মৃত্যুর স্বীকার শ্রমিকদের আমরা নায্য বিচার দিতে পারেনি।পড়ে গেছি সেই বহুল পরিচিত বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায়। 

এছাড়াও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যখনই কোন আন্দোলন হয় তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে মালিক পক্ষ একপ্রকার মারমুখো হয়ে উঠে। যতবারই দাবি উঠুক শোনার আগেই পরিকল্পিত আন্দোলন বা ষড়যন্ত্রের আভাস যেন খুজে পাওয়া এখন রুটিনমাফিক কাজ। পাটকল শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন হলো সেখান থেকে গ্রেফতার হলেন অনেকে। আর অতি সা¤প্রতিক বাঁশখালি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকেরা নিজেদের বেতন-ভাতা ও কর্ম ঘন্টার দাবি জানাতে গিয়ে জীবন দিয়ে দিতে হলো পুলিশের গুলিতে। তবে প্রশ্ন উঠে ১৮৮৬ থেকে ২০২১ শ্রমের মূল্য ও ন্যায্য পাওনা, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের এ দাবি থেকে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে আদতে? শ্রমজীবীদের পেশাগত জীবনের, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো কি অর্জিত হয়েছে? এসব আন্দোলন ও আন্দোলনে করা ব্যবহার লক্ষ্য করলেই  আমরা উত্তর পেয়ে যাই। অথচ পৃথিবী এগিয়েছে মেধা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবিকতায় বলে দাবি করি আমরা।  

করোনা এসে যেন আমাদের চোখেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই রুঢ় বাস্তবতা আরেকবার। অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে শ্রমিকরা কতটা ভঙ্গুর তা আমরা দেখতে পাই করোনার লকডাউনকে ঘিরে।  একদিকে দেশে মহামারী বাড়ছে, সাধারনণ ছুটি অন্যদিকে মহামারী বাড়ছে জেনেও রাস্তায় নামছে, অন্যদিকে গার্মেন্টস, নির্মাণসহ শিল্প কারখানা খোলা রাখা। এসব শ্রমিকের অধিকাংশেরই নেই নিজস্ব পরিবহন কিংবা তাদের যাতায়াতে মালিকপক্ষ হতে কোন ব্যবস্থা। আর এই করোনা মহামারীতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে সম্মুখ সারিতে থাকা হসপিটালের নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া সহ সকল শ্রমিকদের কতজনের বীমা করা রয়েছে কিংবা ঝুঁকি  ভাতা পাচ্ছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর গার্মেন্টস ও অন্য সেক্টরে আমরা গত লকডাউনে দেখতে পেয়েছি সরকারি নির্দেশনা থাকা স্বত্তেও চাকুরি ছাটাইয়ের ঘটনা। একদিকে করোনা সংক্রমনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, অন্যদিকে চাকুরি হারানোর ভয়ের মাঝে নতুন করে যোগ হয়েছে পরিবহন বন্ধ হয়ে বাড়তি বিড়ম্বনা।  আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে শ্রমিকরা বেঁচে আছে দিন এনে দিন খেয়ে। যদিও আমরা গতবছর সরকারী তথ্যমতে দেখতে পাই করোনা ভাইরাসের প্রতিঘাত মোকাবিলায় দেশের রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। 
খবরে দেখতে পাই পোশাক শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের বাধ্যবাধকতা খোদ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তাই  এর সুফল আদৌ শ্রমিকরা কতটুকু পেয়েছে এবং কতজন এর আওতায় এসেছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এ তো গেলো একদিকের শ্রমিকের কথা, অন্যদিকে রয়েছে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যসহ জরুরি পণ্যের বিক্রয় ব প্রতিনিধি, চালকসহ অন্যান্য। তাদের এই করোনায় ঝুঁকি ভাতা, বীমার আওতায় না আনলে একটা সময় ভোক্তারাও আর নিয়মিত সেবা পাবেনা। আনুষ্ঠানিক শ্রমিকরা প্রনোদনা হয়তো পান কিন্তু অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকরা তাও পায় না। কৃষক, রিকশাচালক, মুচি, দোকান কর্মচারী এদের দিকে যেন নজর দেবার কেউ নেই। এদের জন্য ত্রাণ আসে যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগন্য। তাই তো আমরা দেখতে পাই লকডাউন অমান্য করে রাস্তায় নামছে, চলাচল করছে। কারণ তাদের কাছে মহামারী থেকে ভয়াবহ হয়ে উঠে এসেছে নিজের ও পরিবারে ক্ষুধা। করোনা এ মূহর্তে আমাদের নানানভাবে আঘাত করার পাশাপাশি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে শ্রমিকের অনুপস্থতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার  প্রয়োগ ত্বরান্বিত প্রক্রিয়া। দিন যত যাচ্ছে এবং সামনে দিনে অটোমেশনের সাথে নিত্য নতুন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এবং আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে এই কারণে কর্মহীন হয়ে পড়লে তাদের ভরনপোষণ ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবনার, পরিকল্পনা গ্রহনের এখনই সময়। করোনা দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রেই বড় আঘাত হেনেছে। এ আঘাত হতে সকলকে একত্রে বেরিয়ে আসতে হবে।  একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে হবে আরেকদিকে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। তাদেরকে নায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘন্টা, ঝুঁকি ভাতাসহ বীমার আওতায় আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে আগে জীবন বাঁচাতে হবে আর জীবন বাঁচাতে হলে শ্রমিককে তার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর তা করতে হলে রাষ্ট্রীয় ভাবে এগিয়ে আসার পাশাপাশি সামাজিক ভাবেও এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে।

লেখক: বাহাউদ্দিন আবির, শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


/ইই
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন