ঢাকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

Motobad news

পুঁজিবাদের বসন্ত বনাম মজুরের মহামারি   

পুঁজিবাদের বসন্ত বনাম মজুরের মহামারি   
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

জহিরুল ইসলাম:
‘ছোট বেলায় আমাদের পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের পার্থক্য শেখানো হয়েছিলো; পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে মানুষ শোষণ করে মানুষকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো তার সম্পূর্ণ উল্টো। দীর্ঘদিন পরে বুঝতে পারলাম যে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ বিপরীতার্থক নয়; বরং এটা হচ্ছে একে অপরের প্রতিবিম্ব। সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের অবস্থার যত তফাতই থাকুক না কেনো, এদের নির্যাস কিন্তু অভিন্ন। যেখানেই লিখিত ইতিহাস পাওয়া গেছে সেখানেই রয়েছে মানুষের উপর মানুষের শোষণের সুস্পষ্ট নিদর্শন।’  উপরের কথাগুলে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান স্যারের ‘পরার্থ পরতার অর্থনীতি’ বইয়ে লেখা। এ কথাগুলো বলার কারণ আজ বিশ্ব শ্রমিক দিবস। যা মে দিবস হিসেবে সমধিক পরিচিত। এই দিবসটি এমনি এমনি আসে নাই। শোষণের প্রতিবাদে, ন্যায্য অধিকারের দাবি করতে গিয়েও যে নিষ্পেষিত হতে হয় তার উদাহরণ থেকেই মে দিবসের সূচনা। সবার জন্য প্রযোজ্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং নিরাপদ কাজের অধিকার’ এই দাবি হওয়া উচিত আমাদের সবার। মে দিবসের সঙ্গে এই দাবি অবিচ্ছেদ্য। দেশের প্রতিটি নাগরিক কাজ করে নিরাপদে বাঁচার অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। একটি নূন্যতম আয়সীমা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। জাতীয় নূন্যতম মজুরি হচ্ছে ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিতে এ রকম মজুরি, যার নিচে দেশের কোথাও কোনো কাজে, কোনো মজুরি বা বেতন হতে পারবে না। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে এই শর্ত পূরণ করতে হবে। এবং এই মজুরি অবশ্যই বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পরিমাণ হতে হবে। আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের অধিকার এখন বিশ্বে এমনভাবে স্বীকৃত যে তাকে স্বতঃসিদ্ধ বলেই মনে হয়। কিন্তু এই অধিকারের জন্য অসংখ্য মানুষের শ্রম, ঘাম, মেধা কাজ করেছে, অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। যে ঘটনাপ্রবাহ এই মে দিবস তৈরি করেছিল, তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকে, অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কর্মক্ষেত্রে শিশু নারীসহ শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা ও নির্যাতন দূর করার জন্য কয়েক দশকে মানুষের চিন্তা, সক্রিয়তা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কাজের সময় কিংবা মজুরির তখন ঠিক ছিল না। ক্রমেই নারী-শিশুসহ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় জীবন পরিবর্তনের জন্য অসংখ্য প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ তৈরি হয়। সংগঠন গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তা আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকারের দাবিতে একটি ঐকমত্য তৈরি করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিনে তিন লক্ষাধিক শ্রমিকের ধর্মঘটের মধ্যে অন্য অনেক শহরের মতো শিকাগো শহরেও বড় সমাবেশ হয়। আতঙ্কে হামলা করে রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ। প্রতিবাদে আবারও সমাবেশ, আবার হামলা। গুলিতে, সংঘর্ষে শ্রমিক নিহত হন, নিহত হন পুলিশও। পরে প্রহসনমূলক বিচারে সংগঠকদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি ক্রমে প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশ্বের প্রায় সব দেশে মে দিবস এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও এই দিবস পালন করছে নিয়মিত। অবশ্য যে দেশে ‘মে দিবসের’ জন্ম, সেই যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবস পালিত হয় না, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় শ্রম দিবস।

কিন্তু এত বছর পরেও আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নেহাত টিকে থাকতে শুধু আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। এ ছাড়া মজুরিবিহীন শ্রমের অস্তিত্ব আছে, আছে নারীর অস্বীকৃত শ্রম। আইএলও কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও সেই কনভেনশনে স্বীকৃত শ্রমিকদের বহু অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু নিম্নআয়ের মানুষ নন, যাঁরা শ্রমিক বলে নিজেদের ভাবেন না ’এ রকম পেশাজীবীরাও এখন পরিবারের একাধিক সদস্যের রোজগার ছাড়া জীবন চালাতে পারেন না। কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়। একজনের আয়ে অন্তত চারজনের পরিবার বাঁচার মতো আয় করতে পারবেন সেটাই স্বীকৃত অধিকার। তবে পরিতাপের বিষয়, বিশ্বব্যাপী শ্রমিক দিবস পালিত হলেও আজও শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার জ্বলন্ত প্রমান আমরা দেখলাম গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের বাশঁখালীতে ন্যায্য দাবী আদায়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর পুলিশের নির্মম গুলিতে হতাহতের দৃশ্য দেখে। বরাবরই বিশ্বব্যাপী এসব নিম্ন শ্রেণির শ্রমিকরা নিষ্পেষিত হচ্ছে।  তবে তাদের পাশে কেউ জোড়ালো ভাবে থাকে না কখনোই । তাই তাদের দাবিগুলো থেকে যায় অন্তরালে। বিলিয়ে যায় নিমিষেই। কারন এরা সমাজের নিম্নবর্গ।

অথচ শ্রমিকদের হাটু জোরে, বাহু জোরে টিকে থাকে সমাজের, দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে টিকে আছে তৈরী পোশাক শিল্পের উপর। আমরা সবাই এটা নিয়ে গর্ব করি বিশ্ব দরবারে।  অথচ যে শ্রমিকরা এই দুধের গাই সমমনা খাতটি টিকেয়ে রেখেছে দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের কথা আমরা মনে করতে পারি না। তাদের নিয়ে গর্ববোধ করেতে আমরা যেনো লজ্জিত হই। কুণ্ঠাবোধ করি। পোশাক খাত থেকে অধিক হারে মুনাফা অর্জন হওয়া সত্বেও এ খাতের শ্রমিকের শ্রমের মূল্য সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শুধু শ্রমিক নয়, স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের বেতনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। জেট্রোর জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে একজন প্রকৌশলীর মাসিক বেতন ২৮৭ মার্কিন ডলার, ভিয়েতনামে ৪৩৯ ডলার, আর কম্বোডিয়ায় ৬৪৮ ডলার। পাকিস্তান ও ভারতে যথাক্রমে ৪৯২ ডলার ও ৫৯১ ডলার। উৎপাদন খাতের একজন ব্যবস্থাপকের মাসিক বেতন বাংলাদেশে ৭৯৩ ডলার, ভিয়েতনামে ৯৩১ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১১১৭ ডলার, পাকিস্তানে ১২৩৫ ডলার এবং ভারতে ১৩৮২ ডলার। শ্রম সস্তা, ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম। তার মানে মালিক বা পুঁজি লগ্নিকারীদের মুনাফা বেশি। তাঁদের ধনসম্পদ বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। তবে কি এটাই আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির মোদ্দা কথা? এটাই বাংলাদেশের ইকোনমিক মিরাকলের প্রধান রহস্য? তা যদি হয়, তাহলে এটা ভালো কথা নয়। প্রধানত সস্তা শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্মম দিকটা লক্ষ করা প্রয়োজন। জিডিপি আর মাথাপিছু আয়কে অর্থনীতিবিদরা কখনোই উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে পরিগনিত করেন না, যদি সেখানে সম্পদের সুষম বন্টন না হয়। অর্থনীতি সম্পদের সুষম বণ্টনকে প্রকৃত উন্নয়ন মনে করে। গত কয়েক বছরে দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ উন্নত দেশকেও পিছনে ফেলেছে। তার মানে এখানে সুষম বণ্টন নাই। কারন জিডিপির আকার বাড়ছে, কিন্তু শ্রমিকের  মজুরি বাড়ছে না। বাড়ছে না তাদের জীবন যাত্রার মান। অধিক মুনাফা অর্জন করে কিছু মানুষ দ্রুত ধনী হচ্ছে এসব খাত থেকে। অথচ এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশ। গত বছর করোনার শুরুতে দেশব্যাপী যে লকডাউন শুরু হয় সেসময় পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে বিজিএমইএ যে তেলেসমাতি কা- করেছিলো। তা আমাদের কারোই অজানা নয়। এসব শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য সমাজে থাকলেও, শ্রমিকের মূল্য এ সমাজে উপেক্ষিত থেকে যায় অহরহ। সরকার এ খাতে প্রণোদনা সহায়তা দিলেও শ্রমিকদের বেতন নিয়ে যে অসন্তোষ অভিযোগ তা কাটেনি কখনোই। পুঁজিবাদীরা এসব প্রণোদনাও নিজেরাই কুক্ষিগত করেছে বলে অনেকের দাবি।

করোনা পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিম্ন শ্রেণির শ্রমিকরা সমাজে কতটা উপেক্ষিত। সাথে নিম্ন শ্রেণির মানুষও। লকডাউনে রাস্তায় প্রাইভেট কার চলতে পারবে, আকাশে বিমান উড়লে ক্ষতি হবে না, টাকা ওয়ালারা ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে পারবে। কিন্তু রিক্সা ওয়ালারা রিক্সা নিয়ে রাস্তায় নামলে রিক্সা উল্টিয়ে রাখা হবে। কারন তারাই শুধু সমাজে নিম্নবর্গ। তাদের রুটি রুজি বন্ধ হলে যেনো রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি নাই যেনো। রাস্তায় অনিয়ম করে পার্কিং করলে কিংবা আইন অমান্য করলে প্রাইভেট কারের পিছনে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায় না কখনোই। কিংবা কখনোই দেখা যায় না তাদের গাড়ির চাকা ফুটো করে দিতে। কিন্তু একজন রিকশা শ্রমিক ভুল করতেই তার রিকশায় আঘাত আসে। এমনকি আঘাত আসে তার জীর্ণ শীর্ণ শরীরের উপরও। কারণ সে নিম্ন শ্রেণির শ্রমিক। বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী,  বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শিল্পের অবদান ৩৫ দশমিক ৩৬  শতাংশ, কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, সেবা ও মৎস খাতের অবদান যথাক্রমে ৫১ দশমিক ৩০ ও ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।   যার প্রকৃত শক্তি হচ্ছে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ। অথচ সেই শ্রমজীবী মানুষ তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, বাঁচবে কৃষি। কৃষি- শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাঁচবে এ দেশের অর্থনীতি। এখানেই সরকারের দায়িত্ব অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের টিকেয়ে রাখা। কারণ সম্পদের সম বন্টন না হলে সে অর্থনীতি টিকেয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। 

সাবেক শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ।


টিএইচএ/
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন