সবাই আমরা কমবেশি খ্রিস্টীয় আদর্শের পরিপন্থী

আজ বড়দিন। দিনটি পৃথিবীর সর্বত্র লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টানদের সবচাইতে আনন্দের ও মহামিলনের দিন। ক্রিসমাস বা বড়দিন সকল খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে আড়ম্বরের মাধ্যমে পালিত হয়। আবার, অনেকে এই ছুটির দিনটিকে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ও প্রার্থনাপূর্ণ হিসেবে অনিবার্য ভাবগাম্ভীর্য করে তুলেও পালন করেন। আবার এই দিনটিতে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা গির্জায় নির্ধারিত ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে পৃথিবীতে শান্তি ও মানুষের কল্যাণ কামনায় খ্রিস্টের আরাধ্য দিন হিসেবেও আনুষ্ঠানিক করে তোলেন।
খ্রিস্টমাস (খ্রিস্টাব্দ) শব্দটি প্রাচীন ইংরেজী ভাষারীতি ক্রাইস্টেস মাস যিশুর জন্মের বছর থেকেই এসেছে। এর অর্থ খ্রিস্টের জন্য প্রার্থনানুষ্ঠান। বাইবেলে যিশুর জন্মকাহিনীর গসপেল পড়ে এই জানা যায় যে: উত্তর প্যালেস্টাইনের গ্যালিলিও প্রদেশের নাজারথের ছোট্ট শহর-বেথলেহমের অতি দরিদ্র ঘরের জীর্ণ পরিবেশে যে শিশুর জন্ম হয়েছিল। তিনিই যিশুখ্রিস্ট। যার বাবার নাম যোসেফ এবং মায়ের নাম মেরি বা মরিয়াম ছিল।
পৃথিবীর সর্বত্রই মহাপুরুষ ধর্মস্থাপকদের জন্মবৃত্তান্তকে কোনো এক অলৌকিক রহস্যে আবৃত করেই তাঁর অসাধারণত্ব প্রতিপন্ন হয়। যুগে যুগে এটাই যেনো ভক্তকুলের প্রধান প্রয়াস।
কিন্তু মহাপুুরুষেরা তো নিজেদের মহিমাতেই মহিমান্বিত হন। তবুও কিছু অতি ভক্তের দল ধর্মের রহস্যজাল কিংবা কুলগৌরবের মই ঠেকিয়ে ধর্মকে কেবল বাষ্পীয় উচ্চতায় তুলতে চান। কিন্তু যুগে যুগে মহামানবেরা যে কুলে, যেখানে, যেভাবেই জন্ম নেন, সে কুল সূত্রধরের হলেও ধন্য সে তার কর্মে এবং কৃত-কৃতার্থতায়। তবু গসপেলকার লুকের বিবৃতি থেকে আমরা তো এটাই জানি যে : মাতা মরিয়ামের বাগ-বিবাহ হয়েছিল যোসেফের সঙ্গে। কিন্তু তাদের মিলন সম্পর্কের আগেই দেখা গেল, মারিয়া গর্ভবতী হয়েছেন পবিত্র আত্মারই প্রভাবে। যোসেফ ধর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তাই তার মনে ধর্মগত দ্বন্দ্ব দেখা দিলো যে, পিতৃপরিচয়হীন এই দৈব শিশুকে তারই বংশধর বলে স্বীকৃতি দেয়া শাস্ত্রবিধান ও বিরুদ্ধ কাজ হবে।
এই ভেবে যোসেফ, স্ত্রী-মরিয়ামের দুর্নাম করতে না চেয়ে, তিনি তাকে প্রকাশ্যে নয়, গোপনেই দুজন উপস্থিত সাক্ষীর সামনে বিধিসম্মত ত্যাগপত্র দিয়ে তাদের বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করবেন ভেবে মনস্থির করলেন এবং তিনি এ-ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তার বাগদত্তা মরিয়মকে রেখে তিনি অন্যত্র পালিয়ে যাবেন। কিন্তু এমোন সময় প্রভুর এক দূত স্বপ্নে যোসেফকে দেখা দিয়ে বললেনÑ‘দাউদ সন্তান যোসেফ, তোমার স্ত্রী-মরিয়ামকে ঘরে আনতে ভয় করো না। কারণ সে যে সন্তানসম্ভবা হয়েছে, তা পবিত্র আত্মারই প্রভাবে হয়েছে। সে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে।তুমি তার নাম রাখবে যিশু। কারণ, তিনিই আপন জাতির মানুষকে তাদের পাপ থেকে মুক্ত করবেন।’... এমোন লৌকিক স্বপ্নশেষে, হতাশা ও চিন্তগ্রস্ত যোসেফের ভুল ভাঙলো এবং তিনি আনন্দিতও হলেন। এতে তার মনের সন্দেহ দূর হল। তিনি তখন আত্মসম্মানিত হলেন।
তখন মরিয়ামকে স্ত্রী-সম্মানে গ্রহণ করতে, তার আর কোন সংকোচ থাকলো না। অত:পর, মরিয়ামের গর্ভে যিশুর জন্মের কাছাকাছি সময় মাথাপিছু ট্যাক্স ধার্য করার অভিপ্রায়ে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার তার বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র লোকগণনা করবার আদেশ দেন। তখন প্যালেস্টাইনেও বাদশার ফরমান এসে গেল, এবং সেই আহ্বানের সিদ্ধান্ত হল : ইহুদিদের প্রত্যেক গৃহপতি তার নিজের শহরে গিয়ে সেখানে পরিবারের সকলের নাম লেখাতে হবে। সেই উদ্যোগে যোসেফকেও তার পূর্ণগর্ভা স্ত্রী মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে হয়েছিল ডেভিডের জন্মস্থান বেথলেহমে। কারণ রাজা ডেভিড ছিলেন যোসেফের পূর্বপিতামহ।
একই উদ্দেশ্যে বহু লোককেই দূর-দূরান্ত পেরিয়ে আসতে হয়েছিল। মরিয়মের অসুস্থতার কারণে খুব দ্রুত বেথলেহম শহরে আসতে পারেননি যোসেফ দম্পতি। তাই, আগে ভাগেই শহরের সমস্ত সরাইখানায় লোকেরা জায়গা করে নিয়েছিল। বেথলেহমে পৌঁছেই মরিয়মের প্রসব বেদনা বেড়ে উঠলো। নিরুপায় যোসেফ তখন উপায়ান্তর না খুঁজে সেখানকার কোনও এক বাড়ির পরিত্যক্ত নির্জন আস্তাবলে আশ্রয় নিলেন। যেখানে গরু, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, গাধা-খচ্চর থাকে। তেমনই এক স্থানে যোসেফ তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে কোনক্রমে কিছু খড় বিছিয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের জন্য একটু আশ্রয় স্থান করে নিয়েছিলেন। আর সেই রাতেই সমস্ত আঁধার আলোকিত করে মরিয়মের কোলে আবির্ভূত হলেন ত্রাণকর্তা যিশুখ্রিস্ট।
যিনি ছিলেন সৃষ্টির আদি এবং অন্ত কিংবা অনন্ত! তারই জন্ম হল খড়ের বিছানায়। দারিদ্র্যের আবেশে। গোশালায়। সেই গভীর রাতে কেউ ছিলেন না তার পাশে। ফলে, পিতার আপন হস্তেই নবজাতক শিশুটিকে একটুকরো কাপড়ে জড়িয়ে পশুদের জাব দেয়ার তাগাড়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন তাকে।
কিন্তু ইতিহাসের বিবরণ মানতে হলে, যিশু যখন জন্মেছিলেন তখন প্যালেস্টাইন রোমের ঠিক সরাসরি শাসনাধীন ছিলেন না। হেরদই তখন সেখানকার রাজা। ইতিহাসে তিনি চতুর হিংস্র প্রকৃতির রাজা বলেই কুখ্যাত এবং তার মৃত্যুর পরেও জুডিয়া আর গ্যালিলিও প্রদেশেও দীর্ঘদিন হেরদের ছেলের রাজত্বই বহাল ছিল। তাই হেরদকে নিয়েও যিশু সম্পর্কে যেসব কাহিনী প্রচলিত আছে তা ইতিহাসের পাতায় আদপেই আছে কি নেই, তা-না ভেবে বরং সাধু মথির গসপেলে আরও যা বর্ণিত আছে, তা হল : যীশুর জন্মের পরই পূর্বদেশ পারস্য থেকে একদল দৈবজ্ঞ পণ্ডিতেরা জেরুজালেমের বেথেলহমে আসেন। তারা এসে খোঁজ করতে থাকলেন ‘ইহুদীদের যিনি রাজা হবেন’ তিনি কোথায় জন্মেছেন। পূর্বাকাশে যিশুর জন্মলগ্নে উদিত একটি তারার মাধ্যমেই সেই জন্মাবতারের সন্ধান পেয়েছেন। তাই তাকে সম্মান ও আত্মার অর্ঘ্য নিবেদন করতেই তারা সেখানে এসেছেন।
কথাটি হিংস্র হেরদের দরবার অবধি পৌঁছলে, রাজা তখন রাজত্ব হারানোর ভয়ে বেশ খানিকটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। আর তিনি তখনই ইহুদীদের পুরোহিত আচার্য উপাধ্যায় সবাইকে ডেকে এনে, এ বিষয় শাস্ত্রের পুঁথিপত্রে কি লেখা রয়েছে, তা জানতে চাইলেন। তখন রাজগুণীনরা সকলেই বললেন, শাস্ত্রে তো আছেই, যিশু বেথলেহমে জন্মাবেন। রাজা হেরদ তখন দৈবজ্ঞ পণ্ডিতদের ডেকে তাদের কথা শুনলেন এবং তাদের বেথলেহমে যাওয়া নির্দেশ দিলেন। তিনি এও বললেন, যিশুকে খুঁজে পেলে তারা যেনো রাজ দরবারে এসে, শিশুটি কোথায় দেখেছেন, কোনস্থানে আছেন, সেই সংবাদ তাকে জানালে তিনিও সেই শিশুকে দেখতে এবং সম্মান জানাতে যাবেন। রাজার নির্দেশ পেয়ে গ্রহাচার্য পণ্ডিতেরা বেথলেহমের দিকে গেলেন। তারা পূর্বাকাশের যেখানে সেই তারাটি দেখলেন এবং এটি যেখানে স্থির ছিল সেখানেরই এক আস্তাবল বাড়িতে যিশুর জন্মের সন্ধান পেলেন এবং দৈবজ্ঞ আশ্চর্যরা তখন সেখানে গিয়ে শিশুটিকে তার মায়ের কোলে দেখতে পেলেন। পিতা যোসেফও ছিলেন সেখানে।
এরপর পণ্ডিতেরা রাজা হেরদের দূরভিসন্ধি সহজেই অনুধাবন করতে পেরে, তারা অন্যপথে স্বদেশে ফিরে যান। একই রাত্রে যোসেফও ঐশ্বরিক দূতের দৈববাণী মতে, যিশু এবং তার মা মরিয়মকে নিয়ে মিশরের উদ্দেশে পালিয়ে যান।
এদিকে অপেক্ষমাণ চতুর হেরদ বুঝতে পারলেন, দৈবাচার্যরা তাকে ফাঁকি দিয়ে গেছেন। এরপর ক্ষুব্ধ রাজা চটে গিয়ে বেথলেহমে সেই দিনের জন্ম নেয়া সমস্ত ছেলেশিশু হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জল্লাদরা তখন হেরদের সেই নিষ্ঠুর নির্দেশ পালন করে বেথলেহমের ২০/২৫ জন নবজাতক শিশুকে হত্যা করেছিল। কিন্তু যিশুই সেই ব্যক্তি যিনি সেদিন সকল অশুভের হাত থেকে বেঁচে ছিলেন এবং তিনিই তো এই জগতের পাপ ও মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। আর সেই মৃত্যুর চরমমূল্য দিতে তিনিই মনুষ্যপুত্র মুক্তিদাতা হয়ে এভাবেই এসেছিলেন এই মর্ত্যরে ধুলিতে।...
এই উপলব্ধিতেই, যিশুখ্রিস্টের জন্মের এই দিনটি বিশ্বের সকল অসহায়-বিচলিত-বেদনার্তদের প্রতি প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার দিন হিসেবে মহিমান্বিত। আর আধ্যাত্মিক অর্থে এই দিনটি আমাদের জন্যে (মহৎ দিন) ক্রিসমাস কিংবা বড়দিন বলে আখ্যায়িত হয়ে ওঠে। তাইতো, বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বড়োদিন’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়? সেদিন সত্যের নাম ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন সে, যে তারিখেই আসুক। ...সেদিন বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করার দিন, নিজেকে নম্র করার দিন।”
কিন্তু আমরা সবাই আজ কমবেশি খ্রিস্টীয় আদর্শের পরিপন্থী। কেননা, দেশে দেশে এখন যে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের চক্রান্ত চলছে। চলছে সন্ত্রাসবাদ ও আধিপত্যবাদের আগ্রাসন। তাই, নেতৃত্বের একনায়কতান্ত্রিক যুদ্ধে লিপ্ত-রক্তাক্তবিশ্বের এই ভাবমূর্তি কখনোই খ্রিস্টীয় ও খ্রিস্ট-ধর্মের আদর্শ নয়। কারণ, ক্রুশবিদ্ধ চরম লাঞ্ছিত যিশুখ্রিস্ট তো মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এই উক্তি করেছিলেন : পিতা, ওদের ক্ষমা কর। ওরা কি করছে, ওরা তা জানে না।’ (লুক: ২৩-৩৪ পদ) মহত্বের এই দৃষ্টান্তই হচ্ছে, প্রকৃত খ্রিস্টের আরাধনা...।
হেনরী স্বপন : কবি-লেখক, দৈনিক মতবাদ এর যুগ্মসম্পাদক।
এমবি
