ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

হে প্রভু তাকে জিজ্ঞেস করুন কেন আমাকে হত্যা করেছিল

হে প্রভু তাকে জিজ্ঞেস করুন কেন আমাকে হত্যা করেছিল
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

বিশ্বজগতের সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম, প্রতিটি মানুষই আল্লাহর কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চান এই মানব বাগানের একটি ফুলও যেন কেউ হত্যা না করে। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, মানুষ মাত্রই আল্লাহর সৈনিক। অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে সব নির্যাতন, অশান্তি থেকে মুক্ত করতেই মানুষের জন্ম। পাঠক! এই দুনিয়ায় শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা।

কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম। ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও লানত বর্ষিত হয়। কাউকে হত্যা করলে আল্লাহর হক, নিহত ব্যক্তির হক, নিহত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়ের হক নষ্ট হয়। জগতের মালিক বলেছেন, ‘কেউ যখন কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। যে কারও জীবন রক্ষা করে সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’ সুরা মায়েদা আয়াত ৩২। কেউ যখন অন্যায় ও অবৈধভাবে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয় তখন তার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত ও বরকত উঠে যায়।

সমকালীন আমাদের সমাজে নৃশংসতা বেড়ে যেতে দেখছি। দেখছি অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ জন খুন হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের ডকুমেন্টেশন বিভাগের জরিপে যৌতুকের কারণে, পারিবারিক সহিংসতায়, সামাজিক সহিংসতায়, রাজনৈতিক কারণে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, বিএসএফ কর্তৃক, চিকিৎসকের অবহেলায়, রহস্যজনক, গুপ্তহত্যা, ধর্ষণের পর হত্যা ও অপহরণের পর হত্যার যে সংখ্যার উল্লেখ থাকে তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। হত্যা একটি নিকৃষ্ট বিষয়। একটি হত্যা অনেক রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তৈরি করে।

শত নৈরাজ্যের দুয়ার খুলে দেয়। যারা বলেন একজন মানুষ হত্যা এবং সমগ্র মানব জাতি হত্যার মধ্যে মিল কোথায় তাদের বলতে চাই, দেখুন একজনকে হত্যাকারী এবং শতজনকে হত্যাকারী উভয়েই আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী। উভয়েই আল্লাহর লানতে পতিত হবে এবং শেষ ঠিকানা হবে জাহান্নাম। শাস্তির তফাত হলেও একই ঠিকানায় যেতে হবে তাদের। হত্যা নামক নিষিদ্ধ কাজে উভয়েই লিপ্ত হয়েছে। তাই উভয়েই সমগ্র মানব জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

যে ব্যক্তি নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য একজনকে হত্যা করল সে সুযোগ পেলে স্বার্থ হাসিলের জন্য সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করতে পারে। একজন অথবা শতজন হত্যাকারী উভয়েই কিন্তু হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ইমান, আমল ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ক্ষেত্রে সব মুমিন একটি দেহের মতো। সুতরাং কোনো জালিম যখন একজন মুমিনকে হত্যা করল সে ওই দেহের একটি অঙ্গ কেটে ফেলল। যে অঙ্গের যন্ত্রণা জগতের সব মুমিনের হৃদয়কে কাতর করে তুলবে।

শুধু মুমিন হত্যাই নয়, মুসলিমদের অধীনে থাকা কোনো কাফিরকে হত্যা করলেও সে হত্যার বেদনা মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে রসুল (সা.) বলেন, ‘যখন অন্যায়ভাবে কোনো মানুষ খুন হয় সে খুনের একটি অংশের পাপ আদম (আ.)-এর প্রথম সন্তান কাবিলের ওপর বর্তাবে। কারণ সে পৃথিবীতে এ পাপের প্রচলন ঘটিয়েছে।’ বুখারি, মুসলিম।

মানব হত্যা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি তার হত্যাকারীকে এমনভাবে নিয়ে আসবে যে তার কপাল এবং মাথা তার হাতেই থাকবে এবং ঘাড়ের প্রধান দুই রক্তনালী থেকে অনর্গল রক্ত ঝরতে থাকবে। নিহত ব্যক্তি বলবে হে রব! তাকে জিজ্ঞেস করুন কেন সে আমাকে হত্যা করেছিল।’ তিরমিজি। উম্মতদের হুঁশিয়ার করে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না, যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের সমান দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ বুখারি। আল্লাহ সর্বপ্রথম হত্যার বিচার করবেন।

নবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়ে ফয়সালা হবে তা হলো রক্তপাত বা হত্যা।’ বুখারি, মুসলিম। জীবনে প্রশান্তির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে হত্যায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুমিন ততক্ষণ পর্যন্ত দীনের ব্যাপারে পূর্ণ প্রশান্ত থাকে যে পর্যন্ত সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়।’ বুখারি, মিশকাত।

মানুষ হত্যার মহাপাপ থেকে বাঁচতে নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি মহাপাপ থেকে বেঁচে থাকো। যার প্রথমটি হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা। আর তৃতীয়টি হলো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা।’ বুখারি। মানব হত্যার বিষয়ে আল্লাহর অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে নবীজি (সা.) বলেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো মুমিন খুন হওয়ার বিপরীতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহর কাছে অতি গৌণ বিষয়।’ ইবনে মাজাহ।

কোনো ব্যক্তি যদি অমুসলিম থাকা অবস্থায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে, এরপর ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে মুসলিম শাসক ইসলামের স্বার্থে রক্তপাত ছাড়াই ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু কোনো মুসলিম ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য মুসলমানকে হত্যা করলে তাকে কোনোভাবে ক্ষমা করা যাবে কি না এ বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মতে যারা মনে করেন হত্যাকারীর তওবা কবুল হবে না, ক্ষতিপূরণ আদায় করলেও তাকে ক্ষমা করা যাবে না তাঁদের যুক্তি হলো নিহত ব্যক্তির হয়তো আরও দীর্ঘদিন হায়াত পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

হত্যাকারী তার সেই হায়াত ছিনিয়ে নিয়েছে। মৃত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ গ্রহণের সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে। ফলে ইনসাফ হলো, আইনের মাধ্যমে হত্যাকারীকেও একই শাস্তি প্রদান করা। এখানে ক্ষতিপূরণের কোনো সুযোগ নেই। নিহতের হক কেবলই তার নিজের। তার উত্তরাধিকাররা সে হক গ্রহণ করলে নিহত ব্যক্তির কিছু যায় আসে না।

আর ওয়ারিশরা হত্যাকারীর কাছ থেকে যে ক্ষতিপূরণ পাবে তা হলো ওই জিনিসের বিনিময় যা নিহত ব্যক্তি ওয়ারিশদের দিত। ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ওয়ারিশদের হক আদায় হলেও নিহত ব্যক্তির জীবনের ঋণ থেকেই যায়। তা আদায় করার বিকল্প কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন