আজ বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস


ভেটেরিনারিয়ান বা ভেট মূলত তাদেরই বলা হয় যারা সব ধরনের প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রির চিকিৎসা করে থাকেন। প্রাণী চিকিৎসকরাই সাধারণত ভেটেরিনারিয়ান নামে পরিচিত। একটি দেশের পুষ্টি বিশেষ করে প্রোটিন, আমিষের চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এই ভেটেরিনারিয়ানরা।
বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসে সারা বিশ্বের প্রাণী সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ একটি দিন। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শনিবার সারাবিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় দিনটি পালিত হয়।
সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিনামূল্যে প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসূচির মতো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- "Veterinarian response to the COVID-19 crisis."
প্রতিপাদ্যের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়, ভেটেরিনারিয়ানরা কেবল প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখছে তা নয়, তারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অশ্রান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভেটেরিনারি ক্লিনিকগুলো তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম- ফেস শিল্ড, পিপিই, ভেন্টিলেটরের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পিসিআর মেশিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এর ল্যাবে ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ল্যাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কাজ চলছে। ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পিসিআর মেশিন, জনবল বিভিন্ন মেডিকেলে দিয়ে সহায়তা করেছে।
মহামারিতে বিশ্বে ভেটেরিনারিয়ানদের বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে। ফাইজারের কোভিড ভ্যাক্সিন আবিষ্কার টিমের প্রধান ড. আলবার্ট বোরলা একজন ভেটেরিনারিয়ান। পিপিই নিরাপদে পুনঃব্যবহারের কৌশলের আবিষ্কারক এফ. হ্যাঙ্কেনসনও ভেটেরিনারিয়ান।
আমাদের দেশের ভেটেরিনারিয়ান বিজন কুমার শীলের কথা বলতে হয়। সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে দিশেহারা, তখন তিনি করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বিজন কুমার শীল একজন আন্তর্জাতিক মানের বাংলাদেশি ভাইরোলজিস্ট, ভ্যাকসিনোলজিস্ট এবং ভেটেরিনারিয়ান বিজ্ঞানী। এর আগে সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন অবস্থান করা এই ভেটেরিনারি বিজ্ঞানী সেখানে সার্স করোনা ভাইরাস-১ এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করেও অনেক আলোচিত হয়েছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর তথ্য মতে, সারাবিশ্বে যত ভাইরাসঘটিত রোগ আছে তার শতকরা ৭০ ভাগের উৎপত্তি বন্যপ্রাণী থেকে। এ ছাড়া ডব্লিউএইচও বলছে, জীবন্ত বন্যপ্রাণী ধরা ও বিক্রি যদি চলতে থাকে তবে পৃথিবীতে সামনে আরও ভাইরাসঘটিত রোগের সৃষ্টি হবে।
বিভিন্ন প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ানো রোগগুলোকে বলা হয় ‘জুনোটিক ডিজিজ'। এসব রোগের অন্যতম কারণ বন্য জীবজন্তু ও পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ বৃদ্ধি পাওয়া।
বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯, মহামারি এ ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। বাদুড়ের শরীর থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে মনে করেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। কয়েক বছর আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নিপাহ, সার্স, ইবোলা ভাইরাসের জন্যও বাদুড়কেই দায়ী করা হয়।
সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, ইবোলা, মার্স, সার্স, র্যাবিস, অ্যানথ্রাক্স, বোভিন টিবি, মারবুর্গ, লেপটোসিরোসিস এবং বর্তমান কোভিড-১৯ এই সকল বড় বড় মহামারির উৎস প্রাণী। এসব মহামারিতে অতীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে।
মানবকল্যাণে ভেটেরিনারিয়ানরা এইসব রোগের উপর গবেষণা করছে। পৃথিবীর প্রাণিকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে।
এজন্য প্রাণী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওভিএ) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিওএইচও) এবং ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এর সঙ্গে সারাবিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সালে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। জনস্বাস্থ্যের দিক বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হিউম্যান মেডিকেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিকেল সায়েন্সকে একীভূত করে ওয়ান হেলথ ইস্যুতে কাজ করছে। উন্নত দেশে ভেটেরিনারি ডাক্তার ও হিউম্যান মেডিকেল ডাক্তাররা এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে এই সংকট মোকাবিলায়। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভেটেরিনারি ডাক্তার ও মেডিকেল ডাক্তারদের সমন্বয় তেমন নেই বললেই চলে। উভয়েই সমন্বয় সাধন করে কাজ করলেই হতে পারে প্রাণিসম্পদ তথা মানবসম্পদের কল্যাণ।
২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন ভেটেরিনারি পেশার সঙ্গে কর্মরত সকল ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব করে। যেটা নির্ধারিত হয় প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার। দিবসটির মূল লক্ষ্য ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। প্রাণী, পরিবেশ ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাণী পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম দি ভেট এক্সিকিউটিভ আয়োজন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসটি। বর্তমানে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ), দি ভেট এক্সিকিউটিভ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি যৌথভাবে দিনটি নানা আয়োজনের সঙ্গে উদযাপন করে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকেই ভেটেরিনারি শিক্ষা সারা বিশ্বের মানবকল্যাণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সন থেকে চীন দেশের অধিবাসীরা প্রাণীর চিকিৎসাসমূহ প্যাপাইরাস নামক গাছের পাতায় লিখে রাখতেন। ভেটেরিনারিয়ানরা অনেক আগে থেকেই ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, র্যাবিস, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের মতো বিভিন্ন জুনোটিক ডিজিস নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, রোগপ্রতিষেধক টিকা এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে ভেটেরিনারিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। এ পর্যন্ত যতগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই প্রাণিসম্পদের ওপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল।
/ইই
