ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

অতিমারীর বুদ্বুদেই কি, তারুণ্যের মানবিকতাও ক্লান্ত হয়ে গেছে?

অতিমারীর বুদ্বুদেই কি, তারুণ্যের মানবিকতাও ক্লান্ত হয়ে গেছে?
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

এবারের করোনার বিরুদ্ধে লড়াই রূপকার্থে নয়, আক্ষরিক অর্থেই একটি যুদ্ধ। যুদ্ধে যেমন সৈনিক ছাড়াও জনগণেরও একটা ভূমিকা থাকে, এই যুদ্ধেও তাই আছে। হয়তো পারস্পরিক ক্ষেত্রে একটু বেশিই আছে। যুদ্ধ কখনও জনযুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়। এ যুদ্ধও তাই। এটি মুক্তিযুদ্ধ, করোনা থেকে দেশের এবং বিশ্বের মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। এখানে সিভিল সোসাইটি বা সমাজের সবার ভূমিকা থাকবে এবং আছে, এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেমন হয়েছিল, তেমনি...। যার যা আছে তাই নিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ যুদ্ধেও সবার ঝাঁপ দেওয়ার দরকার। করোনার ভয়ে ঘরবন্দি মানুষের মাঝে বিরাজ করছে নানা শঙ্কা। কাজ না থাকায় হতদরিদ্ররা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে, রিকসা-ভ্যান চালক, দিনমজুর এদের ঘরে ঘরে খাবারের হাহাকার। এই হাহাকারের প্রতিধ্বণি ও মধ্যবিত্তদের ঘরের গুমড়ে কান্নাও বিত্তবানদের ডোর-বেলেন মতো টুং টাং বাজছে কিন্তু এতো যে কান্না ও হাহাকার চারিদিকে। চারিদিকে এতো যে, করোনা মহামারী ঢেউয়ের বিপদ চলছে, তা-ও এখনো বরিশালের বিত্তবান ও দয়ালু সেবকদের বন্ধ দরজা কেন যে, খুলছেন না? এ প্রশ্নটাই এখন মানুষের মুখে মুখে সরব হয়ে উঠেছে। এ শহরের শ্রমিক-মজুর এবং নিম্নবিত্ত ঘরের মানুষগুলো কতটা অনাহারে, জলকষ্টে, গরমে ও ডায়রিয়ায় ধুঁকতে ধুঁকতে পিঁপড়ের মতো জীবন কাটাচ্ছে, বস্তির মানুষ, ফুটপাত-স্টেশনের কুলি-মুটে, পরিযায়ী শ্রমিক, অনাথ শিশু-কিশোরের দল এরাও কি এবেলা-ওবেলা না খেয়ে, জলস্পর্শ না করে অনাহারে অর্ধারে আছে না-কি ? তাহলে নগরিক দুর্দশাগ্রস্থ এই শ্রেণির মানুষদের জন্যে আমাদের নগর কৃতজ্ঞতা কি কোনওভাবে অভুক্তদের উদ্দেশে ধাবিত হচ্ছে ? না-কি আমাদের সুশীল মানবিক বুদ্বুদওয়ালাদের সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্যের মানবিকতার বুদ্বুদ ছড়াতে ছড়াতে মনে হয়, তারাও অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছেনে। এক্ষেত্রে রাজনীতিও যতোখানি বাঙ্গময় হতে পারত, মমত্বলেশ এদের বেলায়ও তার ছিটেফোটাও নেই। যদিও প্রথম তরঙ্গের কোভিডের চেয়ে দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত অনেক বেশি ভয়ানক এবং জরুরী বিপদের ঝুঁকিও অনেক ! তা-ও নগর প্রশাসনিক কার্যক্রমের এতো নির্বিকার অবস্থা দেখে, বিস্ময় জাগছে অগাধ।

যদিও সামর্থ অনুযায়ী এখনও বরিশালের বিভাগীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সাধারণ প্রশাসনই এখানকার করোনা মোকাবেলায়  দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে এবং শহরবাসীকে করোনামুক্ত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশে উল্লেখযোগ্যভাবে কোনও রাজনৈতিক দল ও জনপ্রতিনিধিদের পাওয়া যাচ্ছে না। একই অবস্থা রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ক্ষেত্রেও। এরা সবাই যেন স্বেচ্ছায় অন্তরীণ হয়ে আছেন। যা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। এই যুদ্ধে করোনাক্রান্তদের বাঁচাতে সামনের কাতারে কাজ করছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। তারা প্রত্যক্ষভাবে রয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সম্মুখ যুদ্ধে। তাদের সহায়তা দিচ্ছেন চিকিৎসা-বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা। আনুষাঙ্গিক প্রতিষ্ঠান যা সরাসরি মানুষের চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত সেগুলোও এই যুদ্ধের সৈনিক। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোও কি এর মধ্যে পড়ছে না? কাজ করছেন, বরিশালের পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, এরাও সর্বাত্মক জনবল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহযোগিতা করছে। সচেতনতায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। মেট্রোপলিটন পুলিশ তো, সারাক্ষণই নগরের দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কাছাকাছি থাকার সর্বাত্মক চেষ্টাই করছেন। প্রশাসন যতটা সরব ভূমিকা পালন করছে, সেই তুলনায় নগর আশ্রায়ন নিরোর ভূমিকায় অনেকটাই নীরব কেনও? বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। তাহলে, ‘শহর পুড়লে যে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’... আমরা কি সেই মানবিক সত্যটাও ভুলে গেছি ? আমরা তো জানি, প্রচন্ড ঝড়ের বাতাসে তান্ডব উঠলে, ছোট বড় বিবেচনা করে ক্ষতির হিসাব মেলায় না প্রকৃতিরÑ ঘূর্ণিও। করোনার প্রাদুর্ভাব শহরময় মহামারীর অবস্থায় পৌঁছালে কেউ একা বাঁচতে পারবেন না। তাই সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে সবাইকে নিয়ে এই অতিমারী মোকাবেলা করার উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে হবে।    

এবারের করোনায় বরিশালের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থি এই রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে সামর্থ অনুযায়ী কাজ করছেন। স্যানিটাইজার, মাস্ক, হাতধোয়ার উপকরণ ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে মাঠে আছেন। দৈনিক মতবাদের সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেনের নেতৃত্বে বরিশালের পেশাজীবী একদল সাংবাদিক প্রতিদিন লঞ্চঘাটের ছিন্নমূল অভুক্তদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন। এর বাইরে কেউ কেউ হয়তো ছিটেফোটা স্বেচ্ছাসেবার কাজ সাধ্যমত করছেন বটে। কিন্তু এই কাজে বিত্তবানরা সেভাবে এগিয়ে আসছেন না। দেশে থাকা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং স্থানীয় কোম্পানি অপসোনিন, খানসন্স, সুরভী, সুন্দরবন, এম.ই.পি, ফরচুন ইত্যাদি বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের দয়ালু উদ্যোগও এই মুহূর্তে নির্বিকার। তারা নিজেরাও কাজ করছেন না, অন্যদিকে যারা কাজ করছেন তাদের আর্থিক সহযোগিতার হাতও বাড়াচ্ছেন না। কিন্তু এই দুর্বিপাকের আবর্তে সবাই মিলে এগিয়ে না আসলে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা হয়তো একজন নগরপিতার পক্ষে একা মোকাবেলা করা কোনভাবেই সম্ভব না।

বরিশালে সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের প্রচারণা মানুষদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। তারা করোনা রক্ষার নানা প্রচারণার পাশাপাশি সাধ্যমত করোনা রোগীদের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহসহ সবরকম সহযোগিতা করছেন। ডা. মণীষা চক্রবর্তী নিজে করোনা রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তার ন্যায্য অন্দোলন করছেন। অথচ, আমাদের পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীরা স্যাভলন পানিতে হাত ডুবিয়ে কেবল নিজেদের করোনা ভাইরাস মুক্ত হয়ে, নিজেদের জীবন রক্ষা করছেন। ফলে, দুস্থদের দুঃসময়ে এবারে পাশে নেই বরিশালের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি- সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারাও...। ফলে, করোনার এই দুঃসময়ে আমাদের নেতাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি না দেখে পুরোপুরি হতাশ বরিশালের সাধারণ মানুষ।

তবে, এবারের করোনার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সবার জন্য একটিই বার্তা কঠোরভাবে পালন করতে হবে আমাদের, আর সেটা হলো : ঘরে থাকা। সেই সাথে, সরকার সকল জনগণের জন্য- এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয়ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর সেটি বাঁচার জন্য খুব অল্পই কাজ। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই কাজটিই হলো ‘ঘরে থাকা’। জনসমাবেশ এড়ানো বা জনসমাবেশ না করা। মানুষের স্পর্শে না আসা। ঘন ঘন সাবান-জলে হাত ধোয়া। সহজ কিছু কাজ, যদি মন অসহিষ্ণু বা বৈরী হয়ে না ওঠে। অসহিষ্ণুতার কোনো সুযোগ নেই। অন্তত বাঁচার প্রশ্নে, অন্যের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে। করোনা মোকাবিলায় এ-রকম স্বাস্থ্যবিধি উল্লেখ করে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। সরকারের এই প্রজ্ঞাপন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-ইউএসএ এবং বিবিসি’র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তারপরও, যুদ্ধক্ষেত্র অর্থাৎ হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স সরাসরি করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসেন। এক্ষেত্রে হয়তো এরা ক্লিনিক্যাল মাস্ক, পিপিই পরেই আসেন। কিন্তু তবুও তো, রাজনীতির ফাঁক গলিয়ে কালসাপ ঢোকে লখিন্দরের ঘরেই...। 

লেখকঃ কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক


এমইউআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন