ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

কবরীর প্রতি আমাদের সম্পর্ক আনন্দ, শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের

কবরীর প্রতি আমাদের সম্পর্ক আনন্দ, শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

আমাদের প্রিয় নায়িকা কবরী চলে গেলেন। এই চলে যাওয়ার মানে চরম শূণ্যতায় হারিয়ে যাওয়া। অভিনয় শিল্পের দেবীও যদি সরস্বতী হন, তবে নিঃসন্দেহে কবরী সরোয়ারের অত্যন্ত প্রিয় অধিষ্ঠান-স্থল ছিল তাঁর অভিনয়। নেহাতই  কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে নানারকম সাদা-কালো ছবির বিস্তার হয়ে ধীরে ধীরে এই মানুষটি তখন আমারও প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল। সেলিব্রেটিদের সঙ্গে নানা মানুষের নানা সম্পর্ক হতেই পারে? কিন্তু অভিনেত্রী কবরীর প্রতি আমার ভালবাসার সম্পর্ক আনন্দ, শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের। তবে, প্রধানত এই সম্পর্কের সূত্রটা অবশ্যই অমলিন আভিনয়ের। মধ্যদেহী গড়ন, শ্যামলা গায়ের রং, অবিন্যস্ত চুল, সুকুমার মুখম-ল আর তাঁর মায়াবী রৌদ্র¯œাত হাসিÑ যার নাম বললেই পৌঢ়-বাঙালির মনে এই সবকটি গুণের সম্মিলিত একটি মুখ বড় সযতেœÑ পরম মমতায় আমাদের মনে ভেসে ওঠে তিনিইÑ কবরী। আমোঘ রোমান্টিক চুম্বক রূপের প্রখর লাবণ্যে আর শান্ত গরিমায় আমরা সিনেমা পাগল দর্শক মাত্রেই মনে মনে গোপন আকাঙ্খায় কবরীর আপনজন কিংবা তাঁর নায়ক হতে চেয়েছি অনেকেই। 

সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাও কবরীকে যতটা নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন, এতোটা হয়তো বা বাংলাদেশের সিনেমা জগতের অন্য কোনো অভিনয় শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। কারণ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নায়িকাদের গগনচুম্বী চালচ্চিত্রের মধ্যে সম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে থেকে, এখনো যে স্বকীয়তার সন্ধান পাওয়া যায়Ñ কবরীই হচ্ছেন তার এক সুনিশ্চিত উদাহরণ। কৈশোর আর যৌবনের পাট চুকিয়ে ফেলার পরও ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে কবরীর সেই গ্রহণযোগ্যতা সবসময়ই চিরন্তন আছে। সুস্থ ও পরিশীলিত অভিনেত্র হিসেবে মানুষের হৃদয়ের কাছে যেতে পারা, মানুষের ভালোবাসার পাত্র হতে পারাটাই কবরীর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। রোমান্টিকতার মায়াজালে কবরী তার অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়কে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তেমনটা আর কেউ পারেননি। কবরীকে মানুষ মনে করতো, এই শিল্পীটা আমার শিল্পী। আমার কাছের মানুষ। কারণ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে কবরীর মত এতো জনপ্রিয় হৃদয়ের কাছাকাছি শিল্পী আর কেউ নেই। সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ে হিসেবে কবরীকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটা ঠিক সেরকম ছিল। নিজস্ব স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান ছিল তাঁর। অভিনয় শিল্পী হিসেবে কবরী নিজের প্রতিভার পরশমণি দিয়ে নিজেকেই তৈরি করেছেন। মিষ্টি মেয়ে ছাড়া তিনি ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কারণ তার চেহারায়, আচরণে, অভিনয়ে সেই বিষয়টা ছিল। খুব বেশি মেকাপ করতেন না, এমনকি কেশ-বিন্যাশেও একদম সাধারণ বেনি করা বাঙালিয়ানা মেয়ের মত থাকতেন। যার কারণে, মধ্যবিত্ত আতি সাধারণ মানুষের অভিনেত্রী হিসেব্রে তাঁর প্রভুত খ্যাতি ছিল।

বর্তমানের সারাহ বেগম কবরীর আসল নাম ছিলÑ মিনা পাল। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে জন্ম। বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। অভিনয় দক্ষতার জন্য দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের সুতরাং ছবির মধ্যে দিয়ে সিনেমায় অভিষেক হয়, এবং এই ছবির মাধ্যমেই মিনা থেকে কবরী হয়ে যান। সুতরাং...সিনেমার কিশোরী কবরী প্রথম ছবিতেই দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠন। শুরুর দিকে চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক টানÑ দূর করতে চট্টগ্রাম থেকে প্রায়ই ঢাকায় এসে প্রচুর রিহার্সাল করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ মূল চরিত্রে অভিনয়সহ তিনি। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। একাধারে দুই দশকে 'রংবাজ', 'নীল আকাশের নীচে', 'দ্বীপ নেভে নাই', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সুজন সখী', 'সারেং বৌ’ এর মত বহু ব্যবসা সফল এবং আলোচিত সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

বাংলাদেশের সিনেমায় কিংবদন্তীতুল্য রাজ্জাক-কবরী জুটি এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত জুটি। উত্তম-সুচিত্রার মতো এই জুটির ছবিও ছিল সে সময়কার তারুণ্যের ক্রেজ। এদেশের বাংলা সিনেমায় ‘নায়করাজ’ হিসেবে রাজ্জাকের পরিচিয়ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিল। একই ভাবে অভিনেত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় কবরীর স্থানও সবার উপরে ছিল। সুভাষ দত্তের আবির্ভাব চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই এই জুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর এই জুটি অনেক ছবি করেছেন। এদের অসংখ্য হিট ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলোÑ নীল আকাশের নীচে, দর্পচূর্ণ, ময়নামতি, এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জুটির অন্যতম ছবি হলÑ রংবাজ ও বেঈমান অন্যতম। বলা যায়, রাজ্জাক কবরী অভিনয়ে এক ধরণের গভীর রোমাঞ্চ ছিল, হয়তো আভিনয়ের ক্ষেত্রে আবেগের অকৃত্রিমতার কারণেই এই জুটির রসায়ন আজও মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। কবরী কেবল অভিনয়ের জোরেই বাঙালি দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, তাও কিন্তু নয়। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও দীপ্তি ছড়িয়েছেন সমান দক্ষতায়। ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সাথেও জড়িত ছিলেন। অভিনয়ের জন্য তিনি একাধিকবার জিতেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পেয়েছেন, অগণিত সিনেমা ভক্তের ভালবাসা এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সম্মান। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।

করোনার রিপোর্ট পজিটিভ হয়ে ৮ এপ্রিল থেকে ঢাকার একটি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। ১৬ এপ্রিল শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১২টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। অসময়ে হঠাৎ এই গুণীনের চলে যাওয়ায় আমাদের দারুণ ক্ষতি হয়ে গেল...

আমাদের চারপাশে এখন আনেক দু:সময় চলছে, একে একে করোনা আমাদের সাধের, প্রাণের, ভালবাসার মানুষগুলোকে কেড়ে নিয়ে আমাদের অন্তরের শোককে প্রনিয়তই দার্ঢ্য করে দিচ্ছে।


টিএইচএ/
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন