সিয়ামের মাসলা মাসায়েল


ভুমিকা: সিয়াম আল্লাহ তায়ালার নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত। বেশির ভাগ বর্ণনানুযায়ী ইসলামের মৌলিক ইবাদতের মধ্যে এর অবস্থান ৪র্থ কোন কোন বর্ণনানুযায়ী ৫ম। সিয়াম আল্লাহ তাআলার নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি এবাদত। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ এবাদত সম্পাদনের কিছু নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধান রয়েছে, যেগুলো পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা প্রত্যেক মুমিনের একান্ত কর্তব্য। সেগুলোর আলোচনা নিম্নে প্রদান করা হলো।
সিয়ামের আবিধানিক অর্থ: সিয়াম শব্দটি আল্লাহ প্রদত্ত পারিভাষিক শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। অর্থাত্ পানাহারসহ যেকোন ধরনের পাপকাজ থেকে বিরত থাকা। যাকাত, সাদকা নযর, নিয়্যত ইত্যাদি বহু আরবি শব্দের হুবহু প্রচলন আমাদের বাংলা ভাষায় হয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সালাত ও সিয়াম ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়ে রোজা ও নামাজ নামে প্রচলিত হয়েছে। কেননা রোজা শব্দের অর্থ উপবাস বা না খেয়ে থাকা যা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বিধায় এই শব্দটি ব্যবহার থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। যদিও আমাদের দেশে রোজা বলতে সিয়ামকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
সিয়ামের পারিভাষিক অর্থ: সুবহি সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনতৃপ্তিসহ যে কোন ধরণের পাপ থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম।
সিয়ামের নিয়্যত: নিয়্যত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নিয়্যত ছাড়া কোন ইবাদতই আল্লাহতায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু নিয়্যত কিভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। এটি মুখে উচ্চারণ করে আদায় করতে হবে নাকি মনে মনে বলতে হবে। আসলে নিয়ত হচ্ছে অন্তরের বিষয়। আর এর স্থান হচ্ছে ক্বলক বা হৃদয়, যা মুখে উচ্চারণ করে আদায় করা যায় না। নিয়্যত অবশ্যই সুবহি সাদিকের পূর্বে হতে হবে। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি ফজর (সুবহি সাদিক) এর পূর্বে সিয়ামের নিয়্যত না করে তবে তার সিয়াম হবে না (নাসায়ী)।
আযান দেওয়া: আল্লাহর রাসুল (স.) এর জামানায় ইফতার এবং সাহারির আজান দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট মুয়াযি্যন ছিল। মাগরিবের আযানই ছিল ইফতারের আযান। সুযাস্তের সাথে সাথে মাগরিবের আযান হত। মাগরিবের আযান শুরুর সাথে সাথে সাহাবিরা ইফতার করতেন। ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (স.) এর দুই জন মুয়াযযিন ছিল; বিলাল ও ইবনে উম্মে মাকতুম (রা)।,
আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, নিশ্চয় বেলাল (রা) আযান দিতেন। তোমরা খাওয়া ও পান করা অব্যাহত রাখ যতক্ষণ না আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম আযান দেয় আর এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান এরুপ ছিল যে, একজন মিনারে উঠতেন আর অপর জন মিনার থেকে নামতেন (বুখারী ও মুসলমি)। অন্য বর্ণনায় ৫০ আয়াত পড়ার সমপরিমাণ ব্যবধান ছিল (মুত্তাফাকুন আলাইহী)।
তাড়াতাড়ি ইফতার: সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সায়িমের ইফতার করা উচিত্। মুয়াযি্যন আযান দিক আর নাই দিক। সুর্য অস্ত যাওয়াটাই ধর্তব্যের বিষয়। এখন বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সময় অনুযায়ী ১৪/০৪/২০২১ তারিখ সুযাস্তের সময় ছিল ৬.১৯ মিনিট। এখন যদি কেউ সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও সতর্কতার জন্য দুই কিংবা চার মিনিট কিংবা তার চেয়ে বেশি দেরিতে ইফতার করে তা হবে রাসুল (স.) এর সুন্নত বহির্ভূত কাজ। কেননা আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, যখন রাত্র এখান (পূর্বাকাশ) থেকে আগমন করে এবং দিন এখান (পশ্চিমাকাশ) থেকে প্রস্থান করে আর সূর্য অস্ত যায় তখন সায়িম (রোজাদার) ইফতার করবে (বুখারি-হা/১৯৫৪) অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, ততদিন পর্যন্ত মানুষ কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন পর্যন্ত তারা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে (বুখারী-হা/১৯৫৭) আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (স.) এর সাথে এক সফরে ছিলাম আর আল্লাহর রাসূল (স.) সায়িম (রোজাদার) ছিলেন। যখন সূর্য অস্ত গেল তখন তিনি কোন এক সাহাবাকে বললেন, হে উমুক! ওঠো, আমাদের জন্য দুধ ও পানির মিশ্রণ নিয়ে আসো (ইফতার করব)। তখন তিনি (ঐ সাহাবা) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি একটু সন্ধা (দেরি) করতেন। তখন তিনি (আল্লাহর রাসূল) বললেন, (বাহন থেকে) অবতরণ করো আমাদের জন্য দুধ ও পানির মিশ্রণ নিয়ে আসো।
তখন তিনি (ঐ সাহাবা) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি আপনি একটু সন্ধ্যা (দেরি) করতেন, তখন আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, (বাহন থেকে) অবতরণ করো আমাদের জন্য দুধ ও পানির মিশ্রণ নিয়ে আসো। তখন তিনি (ঐ সাহাবা) বললেন, নিশ্চয় এখনও আপনার উপর দিন (দিনের আলো) আছে। তখন তিনি বললেন, (বাহন থেকে) অবতরণ করো আমাদের জন্য দুধ ও পানির মিশ্রণ নিয়ে আসো। তখন তিনি (বাহন থেকে) অবতরণ করে দুধ ও পানির মিশ্রণ নিয়ে আসলে আল্লাহর রাসুল (স.) সেই দুধ ও পানির মিশ্রণ পান করলেন অত:পর বললেন, যখন তোমরা দেখ এখান দিয়ে রাত আসে আর এভাবে দিন চলে যায় এবং তখনই সূর্য অস্ত যায় তখন সায়িম ইফতার করবে। (বোখারী-হা/১৯৫৫) যাইহোক এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে তাড়াতাড়ি করতে হবে।
মেসওয়াক করা: সর্বাবস্থায় মিসওয়াক করা পছন্দনীয়। এখানে সিয়াম থাকা, না থাকা, দিনের প্রথম, শেষ ইত্যাদি বিবেচনায় আনা নিষ্প্রয়োজন। শুকনো অথবা কাঁচা শাখা ব্যবহার করে সায়িমের মিসওয়াক করা নামে অধ্যায় প্রতিষ্ঠা করে ইমাম বোখারী (র) কাঁচা শাখা দিয়ে মিসওয়াক করা বৈধ প্রমাণে আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর রাসুল (স) বলেছেন, যদি আমি আমার উম্মতের উপর কঠিন মনে না করতাম তবে তাদের প্রত্যেক সালাতে মিসওয়াক করার আদেশ করতাম (বুখারী-হা/৮৮৭)। এখানে সায়িমকে পৃথক করে দেখানো হয় নি বরং হাদীছের অনির্দিষ্টতা সিয়ামরত এবং সিয়ামবিহীন সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং প্ররিস্কার হলো যে গাছের কাঁচা বা শুকনো শাখা ব্যবহার করে মিসওয়াক করা সায়িমের জন্য বৈধ।
একইভাবে পেষ্ট বা মাজন ব্যবহার করতেও কোন সমস্যা নেই। কেননা কাঁচা শাখার একটি স্বাদ আছে যেটার ব্যবহার সায়িমের জন্য অনুমোদিত। এখানে এটাও পরিস্কার যে মিসওয়াক ব্যবহারের পর মুখে থাকা লালা খেয়ে ফেললে বা পেটে চলে গেলে সিয়াম নষ্ট হবে না। সাহারীর সময় শেষ হলে মিসওয়াক করা যাবে না মর্মে প্রচলিত ভুল বিশ্বাসের কারণে আমাদের দেশে সাহরীর পর খুব তাড়াহুড়া করে ব্রাস করতে দেখা যায় যার কোন প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া খাদ্যে লবনের পরিমাণ যাচায়ের জন্য রান্নাকারীর খাদ্য চেখে দেখতে কোন সমস্যা নেই। তবে খিয়াল রাখতে হবে কোন অবস্থায় খাদ্য যেন পেটে না যায়।
বমি করা: ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে অবশ্যই সিয়াম ভেঙে যাবে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে কারও বুমি আসলে তাতে সিয়াম নষ্ট হবে না। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে তাকে কাযা আদায় করতে হবে না আর যে ব্যক্তি ইচ্ছকৃতভাবে বমি করবে সে যেন কাযা আদায় করে (তিরমিযী)।
সিয়াম অবস্থায় অযু করা: সিয়াম অবস্থায় কিভাবে অযু করতে হবে সে সম্পর্কে হাদীছে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। লাকিত্ব ইবনে সবরা হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে অজু করবো সে সম্পর্কে আপনি আমাকে বলে দিন। আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, তুমি পরিপূর্ণ ভাবে ওযু করবে, আঙ্গুলের মধ্যে খেলা করবে এবং ভালোভাবে নাকে পানি দিবে; তবে তুমি যদি সায়িম হও তবে নাকে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করবে (আহমদ)।
সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা: সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা জরুরি নয়। এখানে শরীয়তের পক্ষ হতে সিয়াম পালন না করার অনুমতি রয়েছে। তবে তাকে অন্য সময় পালন করে নিতে হবে। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (স.) সফরে ছিলেন। অত:পর তিনি এক লোককে দেখতে পেলেন সেখানে মানুষের ভিড় করে আছে। আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, তার কি হয়েছে? সাহাবীরা বললেন, তিনি একজন সিয়াম পালনকারী। আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, এটা পুণ্যের বিষয় নয় যে তোমরা সফরে সিয়াম পালন করবে (বুখারী ও মুসলিম)। হামযা ইবনে আমর আল-আসলামী হতে বর্ণিত তিনি বলছেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এমন একজন ব্যক্তি যার সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করার ক্ষমতা রয়েছে। সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করলে কি আমার গুনাহ হবে? আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, এটি হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে অনুমতি। যে এটি গ্রহণ করবে সেটা ভালো আর যদি কেউ সিয়াম পালন করতে পচ্ছন্দ করে তাহলে সেক্ষেত্রে কোন সমস্যা নাই (বুখারী)।
মৃত্যু ব্যক্তির পক্ষ থেকে সিয়াম পালন: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মারা গেল এমন অবস্থায় যে তার উপর সিয়াম আছে। আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন, তার পরিবার তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করবে (বুখারী ও মুসলিম)।
লেখক: মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক, আরবি
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ
কে.আর
