মাসিক ‘সঙ্গীত’ এর প্রকাশক তরুণ রায়ের প্রয়াণ দিবস পালিত


১০ আগস্ট বাংলাদেশের প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা মাসিক সঙ্গীত এর প্রকাশক তরুণ রায়ের ২৬তম প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশ কবিতা সংসদের উদ্যোগে খোলাচোখ ও অনন্য কথা পত্রিকার আয়োজনে এটিভি লন্ডন অনলাইন চ্যানেল থেকে রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত স্মৃতিচারণ, গান ও স্বজন প্রিয়জনদের আলোচনায় অনুষ্ঠিত হলো তরুণ রায় স্মরণাঞ্জলি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর জীবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ট দুজন সহচর আক্তার আহমেদ চৌধুরী ও মুত্তালিব বিশ^াস, স্ত্রী বকুল রায়, বোন ফুলরেণু রায়, কন্যা সেতু রায়, পাবনার প্রতিনিধি ও সঙ্গীত শিল্পী শফিক উদ্দিন আহমেদ, খোলাচোখ পত্রিকার সম্পাদক মানিক মজুমদার ও অনন্য কথা পত্রিকার সম্পাদক ‘মাহফুজ আলী কাদেরী।
পাবনা জেলার,বেড়া উপজেলায় মৈত্রবাধা গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্র“য়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সনে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজ বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে লুকানো অবস্থায় রাতের অন্ধকারে দেশের ডাকে মা বাবা, ভাই বোনদের কাঁদিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়া দেন। চরম কষ্টে পায়ে হেঁটে, হিলি বর্ডার দিয়ে প্রায় ৭ দিন পর ভারতে পৌছান। সেখানে আপন মামা মাসিদের কাছে আরাম আয়েশে দিন না কাটিয়ে তিনি ক্যাম্পে যোগদান করেন এবং সম্মুুখ যুদ্ধের জন্য অস্ত্র হাতে ট্রেনিং নিতে থাকেন। সেখানে বাংলাদেশের অনেকের সাথেই দেখা হয়।
এর মধ্যে, অধ্যাপক আবু সাইদ ও সামছুল হক টুকু (এমপি) সাথে দেখা হওয়ায়, উনারা তাঁকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী হওয়ায় বেতারে গান গাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্পে জাগরণি মূলক গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করতেন তরুণ রায়।
তরুন রায় ১৯৭১ পূর্ব থেকেই জয়বাংলা শিল্পী গোষ্ঠী নামে তাঁর একটি সঙ্গীতের দল ছিল, তাঁদের নিয়ে ট্রাকে করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়াতেন। এতে বহু মানুষ দেশের স্বাধীনতার প্রতি উৎবুদ্ধ হতো। তিনি মনে প্রাণে দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর জীবদ্দশায় কঠোর পরিশ্রম ও নিজ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের একমাত্র সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা "মাসিক সঙ্গীত" প্রকাশ করেন। তরুণ রায় ভাই, বোন: মোট তিন ভাই, পাঁচ বোন। অত্যন্ত কর্তব্য পরায়ণ সন্তান ও দায়িত্বশীল বড় ভাই ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা সেতু রায় নেদারল্যান্ড প্রবাসী।
তাঁর একটি অত্যন্ত সফল সঙ্গীত সংগঠন, "সংকেত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী " ছিল। সেখান থেকে প্রতি বছর সারা বাংলাদেশের, জীবিত বৃদ্ধ গুণিজনদের ক্রমান্বয়ে ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দিতেন। এ ছাড়াও সমাজের নানামুখি জনকল্যাণ মূলক কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর অকাল মৃত্যু সমাজ ও সংসারের জন্য এক অপরিসীম ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
লেখক: ফুলরেণু রায়, কণ্ঠশিল্পী, ও অধ্যাপক, তরুণ রায়ের ছোট বোন।
ক্ষণজন্মা মহাপ্রাণ তরুণ রায়
বকুল রায়
শব্দ সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা তরুণ রায়ের ২৬তম মৃত্যু দিবস ১৯৯৫ সালের ১০ আগষ্ট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক, বাংলাদেশ বেতারের উপ নিয়ন্ত্রক বার্তা, সংকেত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশের একমাত্র সংগীত বিষয়ক পত্রিকা মাসিক সংগীত এর প্রতিষ্ঠাতা তরুণ রায় পরলোক গমন করেন ।
পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার মৈত্রবাধা গ্রামের স্কুল শিক্ষক বাবা তারাপদ রায় ও মা গৌরাঙ্গীনি রায় এর পাঁচ মেয়ে দুই ছেলের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তরুণ রায়। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন সংগীত জানা ব্যক্তিত্ব। তাই ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেন তিনি। স্কুলের গন্ডী পেরোনোর পর তাই সংগীত নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন ঢাকার মিউজিক কলেজে । বি মিউজ পড়াকালীন সময়ে শুরু হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যান ট্রেনিং নিতে। সেখানে ৭নং সেক্টর কুরমাইল কাম্পে বেড়া পাবনার এম এন এ অধ্যাপক আবু সাঈদ এর পৃষ্ঠপোষকতায় শ্মরনার্থী শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলেন। তিনি সংগ্রাম পরিষদ এর সম্পাদক ও শিল্পী দলের সামগ্রিক পরিচালক ছিলেন । এ ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেরও একজন অন্যতম কন্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ এ বাংলাদেশ বেতারের বার্তা বিভাগে সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক হিসাবে চাকুরীতে যোগ দেন। ১৯৭৩ এর ১০ অক্টোবরে সহকন্ঠযোদ্ধা বকুল কুন্ডুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯৭৪ এ তাদের একমাত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৭৫ সালে কাকরাইলের এক ভাড়া বাসায় সংকেত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং সংগীত বিষয়ক প্রথম পত্রিকা “ মাসিক সংগীত “এর গোড়াপত্তন হয়। সংকেত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নিয়মিত দেশব্যপী সংগীত প্রতিযোগীতা, জীবদ্দশায় গুণীজন সম্বধর্না ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সংগীত বিষয়ক পত্রিকা মাসিক সঙ্গীত বাংলাদেশের সংগীত অংগনে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল । মাত্র ৪৬ বছর বয়সে একটি সামান্য পাইলস অপারেশন করাতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেলে অতিরিক্ত এনেস্থিসিয়ায় না ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী ব্যক্তি ।
তাঁর ২৬তম প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও স্বর্গবাস কামনা করছি।
লেখক: বকুল রায়
কণ্ঠশিল্পী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, তরুণ রায়ের সহধর্মিণী।
এমবি
