করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের বাড়ি হচ্ছে না লকডাউন, বরিশালে বাড়ছে সংক্রমন

৯ এপ্রিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন নগরীর নিউ সার্কুলার রোডের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন। ৮২ বছর বয়সে কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে তিনদিন করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার ছেলে দিপু জানিয়েছেন, পিতার মৃত্যুর পরে নিজেদের সচেতনতায় বাইরে যাওয়া আসা কম করছেন। তাছাড়া পরিবারের কেউ কভিড-১৯ সংক্রমিত নেই। তবে প্রশাসন থেকে কোন যোগাযোগ বা নির্দেশনা তাদের দেওয়া হয়নি।
তারও দুইদিন আগে ৭ এপ্রিল বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মৃত্যুবরণ করেন করোনা আক্রান্ত আব্দুল খালেক। খালেকের ছেলে শাহীন জানিয়েছেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের বাড়ি বা ঘর লকডাউনের কোন নির্দেশনা পাননি। আজ সোমবার (১২ এপ্রিল) মোটরসাইকেল চালিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন তিনি। কথা হয় সেই অবস্থায়। শাহীন আরো জানান, লকডাউন না দিলেও পরিবারের সবাই আমরা সচেতনতা অবলম্বন করে চলছি।
শুধু এই দুটি পরিবার নয়, মার্চ মাসে বরিশালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর থেকে মারা যাওয়া কারো বাড়ি লকডাউন করেনি স্থানীয় প্রশাসন। তাছাড়া বরিশাল জেলায় মোট আক্রান্তের ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ রোগী বাড়িতে অবস্থান করলেও লকডাউনের আওতায় আনা হচ্ছে না। ফলে দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, আক্রান্ত রোগী বা মারা যাওয়া রোগীর স্বজনরা কোন ধরণের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলেন না। অনেকেই নিকটস্থ বাজারে নিয়ম করে চা খেতে যান। স্বজনদের সাথে আড্ডাবাজী করেন। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে নিত্যদিনের বাজারও করেন। কভিড-১৯ প্রমানিত রোগীরাও এমনভাবে চলাচল করেন। এতে করে অসাবধনতাবশত অন্যান্যরা সংক্রমিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন প্রয়োগ ছাড়া করোনা সংক্রমন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতনরা।
স্বাস্থ সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, হঠাৎ করে বরিশালে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারন আক্রান্ত বা মৃতের বাড়ি লকডাউন না করা। অথচ করোনা সংক্রমনের প্রথম ধাপে সরকারের এই নির্দেশনা কঠোরভাবে পালন করা হতো। কিন্তু হঠাৎ করে কেন সংক্রমিত পরিবারগুলোর প্রতি উদাসীনতা তার সুস্পষ্ট কোন ব্যখা নেই কারো কাছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ৯ মার্চ বরিশালে প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ হাজার ৫১৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে ২২৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ঢেউয়ে ভর্তি হওয়া সর্বশেষ রোগী ছিলেন মঠবাড়িয়ার বাসিন্দা এক নারী। তিনি ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এরপর থেকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে কোন রোগী ভর্তি ছিল না। কিন্ত এই বছরের ৭ মার্চ কভিড-১৯ দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমিত হয়ে প্রথম রোগী ভর্তি হয়। আর বর্তমানে এখানে দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছেন।
জানা গেছে, বরিশাল জেলায় বিগত ১১ দিনের মধ্যে ৭ দিনই সংক্রমন বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন ১ এপ্রিল ২৯ জন। ২ এপ্রিল ২৪ জন, ৩ এপ্রিল ৩২ জন, ৪ এপ্রিল ৩৪ জন, ৫ এপ্রিল ৪৮ জন, ৬ এপ্রিল ৬৪ জন, ৭ এপ্রিল ১০৭ জন, ৮ এপ্রিল ১৪ জন, ৯ এপ্রিল ৬৯ জন, ১০ এপ্রিল ৮৯ জন এবং ১১ এপ্রিল ৩১ জন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন। এই ১১ দিনে মোট আক্রান্ত শনাক্ত ৫৪১ জনের মধ্যে মাত্র ২৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাকি ৫১৪ জন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু জেলার দশটি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিগত ১১ দিনে একটি বাড়িও লকডাউন হয়নি।
এ বিষয়ে বরিশাল সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক আক্রান্ত বা মৃতের বাড়ি লকডাউন করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া আছে। সেটি কার্যকর করবেন জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানান। সিভিল সার্জন বলেন, আক্রান্ত বা মৃতের বাড়ি লকডাউন করা না হলে সংক্রমন ছড়িয়ে পড়বে এটিই স্বাভাবিক। কারন তাদের স্বজনরা সবার সাথে ওঠাবসা করলে তাদের মাধ্যমে সংক্রমিত হতেই পারে।
জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লকডাউনের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। জেলা পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, লকডাউন কার্যকর করে থাকেন জেলা প্রশাসন। তাই জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায়ও একইভাবে লকডাউন হওয়া কোন বাড়ির খবর জানা যায়নি।
মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, আক্রান্ত শনাক্ত বা মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা সচেতন হলে সংক্রমন কমবে। আক্রান্ত শনাক্ত বা মারা যাওয় ব্যক্তিরদের বাড়ি ‘লকডাউন’ করা হলে ওই পরিবারটি অসহায় হয়ে যায়। সেই পরিবারের জন্য অনেক লজিস্টিক সার্পোট দরকার। এজন্য আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে উৎসাহিত করছিল। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মোঃ ফারুক জানিয়েছেন, গত বছর করোনা প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশনের যে ভূমিকা ছিল এ বছরও তার কমতি থাকবে না। লকডাউন প্রশ্নে বলেন, চলমান লকডাউনে সারাদেশেরই চিত্র প্রায় একই। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হবে তাতেই সংক্রমন কমে আসবে বলে আসা তার। কিন্তু মারা যাওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি লকডাউনের প্রশ্নে সরাসরি কোন উত্তর দেননি এই নগর কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাস বলেছেন, আক্রান্তদের তথ্য আমরা জানিয়ে থাকি। কিন্তু লকডাউন করার এখতিয়ার আমাদের নেই। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিবেন।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, গতবছরতো একটি ভয় ছিল সবার ভিতরে। অপনাদের হয়তো মনে আছে, করোনার মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ এলাকায় ঢুকতে দিত না এমন ঘটনাও ঘটেছিল দেশে। বাস্তবতা হলো যে পরিবারটি লকডাউন করা হয় সেই পরিবারটি আসলে সম্পূর্নরূপে অসহায় হয়ে পড়েন। এজন্য নির্দেশনা রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। জেলা প্রশাসক বলেন, শুধু আমার কোর্টে বল দিলেই হবে না, সিভিল সার্জন, পুলিশ প্রশাসন সবার সহায়তায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে সকলের দায়িত্ব রয়েছে।
তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা চেয়ে বলেন, মারা যাওয়া বা আক্রান্ত শনাক্তের তথ্য আমাকে দিলে আমি ওই বাড়িটি লকডাউনের ব্যবস্থা করবো।
এসএমএইচ
