ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news
কঠোর লকডাউন

  স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা সচল রাখতে চান শিল্প মালিকরা

   স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা সচল রাখতে চান শিল্প মালিকরা
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় চলমান লকডাউন শেষে  ১৪ এপ্রিল থেকে আবারো কঠোর লকডাউন দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। গণপরিবহনসহ বন্ধ রাখতে হবে শিল্প-কারখানা। তবে শিল্প-মালিকরা বলছেন, কঠোর ওই লকডাউনে কারখানা সচল রাখতে চান তারা।

দেশে গত বছরের মার্চে করোনার সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয়। মার্চের মধ্যভাগ থেকে কিছু রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজ থেকেই কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি বা অঘোষিত লকডাউন শুরু হলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পরে শর্ত মেনে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা সচল রাখতে শুরু করেন কারখানা মালিকরা। অর্থনীতির গতি ফেরাতে প্রায় দুই মাস পর লকডাউন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ততদিনে স্থবিরতার প্রভাব পড়তে শুরু করে অর্থনীতিতে।

এ স্থবিরতা কাটিয়ে দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছিল দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে শুরু হয়েছে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। গত মাসের শেষ দিক থেকে স্বাস্থ্য খাতে এ ঢেউয়ের প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। দৈনিক মৃত্যু ও সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড ভাঙছে প্রায় প্রতিদিনই। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৯ এপ্রিল থেকে লকডাউন চলছে। আরো কঠোর লকডাউনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। এ পরিস্থিতিতে কারখানা সচল রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার মালিকদের মধ্যে। মহামারী পরিস্থিতিতে কারখানা পরিচালনার পূর্বাভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন সচল রাখতে চাইছেন তারা। নতুন প্রণোদনার দাবিও তুলতে শুরু করেছেন অনেকে।

রফতানিমুখী শিল্পসংশ্লিষ্ট মালিকরা বলছেন, সরকার এখন কঠোর লকডাউনের কথা বলছে। যদিও কোনো বিধিনিষেধ বা প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়নি এখনো। পোশাক খাতকে এ বিধিনিষেধের আওতামুক্ত রাখার দাবি তাদের।

তাদের ভাষ্যমতে, আট-নয় মাস ধরে করোনা পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন তারা। স্বাস্থ্যবিধি-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রটোকলের ভিত্তিতে চালু রেখেছেন উৎপাদন কার্যক্রম। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, পোশাক শ্রমিকদের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম, ১ শতাংশেরও নিচে। চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়েও এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যে খুব কমই আক্রান্ত হয়েছেন।

শিল্প-মালিকদের দাবি, পরিস্থিতি এখন জটিল। কিন্তু এখনই সবকিছু বন্ধ করে শ্রমিকদের ছেড়ে দেয়া হলে তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকিও বাড়ে। এছাড়া তাদের বেতন পরিশোধ নিয়েও ঝামেলা দেখা দিতে পারে। এখনো শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর সুযোগ রয়েছে। প্রতি বছরই ঈদের আগে তিন-চার সপ্তাহ প্রচুর কাজ থাকে, এবারো থাকবে। এসব কাজের কাঁচামালও কেনা হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে কাজের ব্যাঘাত ঘটলে আবারো স্টকলটের (অতিরিক্ত মজুদ চাপ) আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

রফতানিমুখী শিল্পের প্রধান খাত পোশাক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশগুলো আমাদের পাশাপাশি প্রতিযোগী দেশগুলোতেও দেয়। আমাদের জানামতে প্রতিযোগী দেশ কোনোটিই এখনো লকডাউনে যায়নি। সামনের দিনগুলো, বিশেষ করে ঈদের সময়টা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সরকারকে আবেদন করে রাখতে চাই। নীতিনির্ধারণী মহল আমাদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করবে, সে আশাবাদই আমরা জানিয়ে রাখতে চাই।


শিল্প-কারখানার ব্যবসার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে রফতানিমুখী শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো এখন কেবল কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এখন সামনের দিনগুলোর ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া গত আট-নয় মাসের রফতানি পরিসংখ্যান এ খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। ক্রয়াদেশ দিতে ক্রেতারা এখনো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী হিসেবেই বিবেচনা করছেন বাংলাদেশকে। যদিও আগে যেভাবে ১০-১১ ঘণ্টা কারখানা সচল রাখতে হতো, সে পরিমাণ কাজ নেই। এর পরও প্রায় সব কারখানায়ই ৮ ঘণ্টা সচল রাখার মতো কাজ আছে। এদিকে রোজার ঈদের দুই মাস পরই আসছে কোরবানির ঈদ। সব মিলিয়ে বছরের এ সময়টাতেই চাপে থাকে কারখানাগুলো। যেহেতু ক্রয়াদেশ আছে, কাঁচামালও চলে এসেছে, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন চালিয়ে নেয়ার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।

বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কভিডের প্রথম ঢেউ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। আট-নয় মাস ধরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের মাধ্যমে উৎপাদন সচল রাখার দক্ষতা গড়ে উঠেছে শিল্প-মালিকদের। অন্যদিকে কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশের বিপরীতে চলমান উৎপাদন নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হবে। এ মুহূর্তে শিপমেন্ট নিয়েও কারখানা মালিকরা কিছুটা চাপের মধ্যে আছেন। লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখলে আকাশপথে শিপমেন্টের চাপ বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। তবে আমরা চাই লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা সচল রাখার অনুমতি দেয়া হোক।

রফতানিমুখী শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু পোশাক খাতের কারখানাগুলো খোলা রেখে ক্রেতাদের ধরে রাখা যাবে না। কারণ এর সঙ্গে বস্ত্র ও গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ কারখানাগুলোও যুক্ত। সুতা, কাপড় ও অ্যাকসেসরিজের অভাবে পোশাক কারখানার উৎপাদন চালু রাখা নিয়ে সংশয় রয়ে যাবে।

এ বিষয়ে ওয়েল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান ও সিইও এবং বিটিএমএ ও এফবিসিসিআই পরিচালক সৈয়দ নুরুল ইসলামের ভাষ্য হলো, গত বছর টাস্ক ফোর্স গঠন করে কারখানা খোলা রাখা হয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে। আজকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, সেদিন টাস্ক ফোর্সের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আবারো যদি লকডাউনের কারণে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা বন্ধ রাখা হয় তবে পুরো খাতই একেবারে শেষ হয়ে যাবে। সরকারের প্রণোদনা বলি আর সহায়তা বলি কিছুই কাজে আসবে না। তাই সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ বস্ত্র, পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ খাতের কারখানাগুলোকে লকডাউনকালে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগের মতো খোলা রাখার সুযোগ দিলে আমাদের রফতানি খাত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে।

দেশের শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত ছয় এলাকায় কারখানার সংখ্যা ৭ হাজার ৬০২। এসব কারখানায় কর্মরত ৪০-৪১ লাখ শ্রমিক। গত বছর ঈদের সময় তাদের অবস্থান নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছিল শিল্প পুলিশ। কিন্তু বিষয়টি তদারক করে যথাযথ নজরদারি সম্ভব হয়নি। কারণ ঈদের ছুটিতে কারখানা এলাকার বাইরে যাওয়া যাবে না বলে ঘোষণা থাকলেও সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে অনেকে যেতে পারবেন। ফলে শ্রমিকদের একটা অংশ কারখানা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আবার অনেকে যেতে চাইলেও আর্থিক কারণে যেতে পারেননি।

পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন সচল রেখে কীভাবে কভিড-১৯ মোকাবেলা করা যায়, সে বিষয়ে এরই মধ্যে শিল্প-মালিকরা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লকডাউনের মধ্যেও কারখানা সচল রাখার অনুমতি প্রয়োজন আমাদের। আর পরিসংখ্যান বলছে, এ মুহূর্তে বিটিএমএর সদস্য কারখানাগুলোতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের কাজ চলমান আছে। সামনে আসছে ঈদ। সব দিক বিবেচনায় লকডাউনে কারখানা সচল রাখার অনুমতি প্রয়োজন।


টিএইচএ/
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন