সাংবাদিক লিটন বাশার কে হারানোর দিন আজ


আজ ২৭ জুন। বরিশালের সাংবাদিকদের স্বজন হারানোর দিন। ২০১৭ সালের এই দিনে সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। দেখতে দেখতে চারটি বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিক অঙ্গনের প্রিয়জন লিটন বাশারকে হারানোর শূন্যতা পূরণ হয়নি আজও। তাঁকে চিরতরে হারিয়ে অভিভাবক শশূন্য হয়ে পড়েন কর্মরত অনেক সাংবাদিক। তাই স্মৃতির অগোচরে রয়ে গেছেন সহকর্মী দৈনিক ইত্তেফাক এর ব্যুরো প্রধান ও বরিশাল প্রেসক্লাবের একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিটন বাশার। প্রতি বছর জুন মাস এলেই স্বজন হারানোর শোকে শোকাহত হয়ে পড়ছে বরিশালের সাংবাদিকপাড়া।
বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের সন্তান লিটন বাশার ২০১৭ সালে স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র শ্রেষ্ঠকে সাথে নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে ঈদ উদযাপন করতে বাড়িতে যান। সুস্থ সবল মানুষটি ঈদের দ্বিতীয় দিন ভোরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিস্তব্ধ শহরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পরিবারের সদস্যরা একটি ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক যোগে নিয়ে যান শেবাচিম হাসপাতালে। চিকিৎসকরাও তাঁকে সুস্থ করে তুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে চিরতরে বিদায় নেন স্বজন লিটন বাশার। তার চির বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকে ছায়া নেমে আসে বরিশাল মিডিয়া অঙ্গনে। যা আজও ভুলতে পারেননি তারা।
তৃণমূল থেকে উঠে আসা সাংবাদিক লিটন বাশার সাংবাদিকতাকে ধ্যান ও জ্ঞান মনে করে এ পেশায় প্রতিষ্ঠা পেতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি বরিশালের স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে কাজ করার পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকা ভোলা জেলায়ও অবস্থান করে দীর্ঘদিন সেখানে সাংবাদিকতা করেছেন। সংবাদের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন বরিশালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তিনি পেশাগত অনেক সাংবাদিকের ভরসার আশ্রয়স্থল হিসেবে তাদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন সবার আগে।
তাঁর কাছে কোন সাংবাদিক সমস্যা নিয়ে গিয়ে সমাধান পাননি এরকম নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বরিশালসহ দেশের কোথাও সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির খবর কানে আসলেই রাজপথে সর্বাগ্রে সরব হতেন লিটন বাশার। ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদী সহকর্মীদের নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন তিনি নির্ভয়ে।
আদর্শিকভাবে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এ মানুষটি সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় কারো সাথে কখনো আপোষ করেননি। এজন্য তাঁকে নির্যাতনের পাশাপাশি হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। সদাহাস্যোজ্জ্বল ও ভালো মনের অধিকারী লিটন বাশার সবসময় নিজস্ব কর্মস্থলের পাশাপাশি বরিশাল প্রেসক্লাবকেও জমিয়ে রাখতেন প্রাণবন্ত আড্ডায়। প্রেসক্লাবের স্বার্থের প্রশ্নেও তিনি ছিলেন অবিচল।
বরিশাল প্রেসক্লাবের নির্বাচন এলেই তাকে ঘিরে সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্যানেল তৈরীর মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতো। বয়সে প্রবীণ না হলেও নির্বাচনী কৌশল ভালভাবে রপ্ত করার কারণে লিটন বাশার প্রবীণ সাংবাদিকদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। মূলত তার নেতৃত্বেই প্রবীণ-নবীন সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠিত হতো।
কথিত আছে তিনি যেই প্যানেলকে সমর্থন করতেন অথবা যাদের যাদের সমর্থন করতেন বিজয়ের ক্ষেত্রে তাদের পাল্লাই বেশী ভারি ছিলো। তাঁকে বরিশালের সাংবাদিক অঙ্গন জানতো একজন নির্বাচনী মেকার হিসেবে। তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের গুণে তিনি নিজে যেমন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হতেন, তেমনি তাঁর প্যানেলকেও বিজয়ী করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন।
তিনি অল্প সময়েই সাংবাদিকদের নেতৃত্ব পর্যায়ে আসীন হন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব নির্বাচনে তিনি সভাপতি পদে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে তুমূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে মাত্র এক ভোটে পরাজিত হন। তবে তাঁর নেতৃত্বের গুণে ওই সময়কার তাঁদের প্যানেলের সদস্যরা সাধারণ সম্পাদকসহ বেশীরভাগ পদেই জয় লাভ করেছিলেন।
লিটন বাশারের মৃত্যুতে বরিশাল সাংবাদিক অঙ্গনে নেতৃত্বের সংকট হয়েছে এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে যেভাবে সংগঠনকে গতিশীল রাখতেন তাতে আজ ভাটা পড়েছে। সাংবাদিকদের বিপদে আজ আর তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়না। জীবদ্দশায় লিটন বাশার পেশাজীবী সাংবাদিকদের সংগঠন বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। বিনোদন-প্রিয় মানুষ লিটন বাশার বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠনভুক্ত অন্যতম নাট্য সংগঠন প্রজন্ম নাট্যকেন্দ্রের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ কয়েক বছর।
লিটন বাশার মৃত্যুকালে বাবা, ছোট ভাই, সহধর্মিণী ও অবুঝ এক সন্তান রেখে গেছেন। তাঁর পরিবারের স্বজনরা এখন কেমন আছেন সে খবর এখন আর তাঁর সহকর্মীদের অনেকের কাছেই নেই বললেই চলে। তবে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর এইদিনে তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করবেন তাঁর অনুসারী ও শুভাকাঙ্খীরা। তিনি যেখানে যেভাবে থাকবেন, মহান দয়ালু সৃষ্টিকর্তা তাঁকে ভালো রাখবেন এমন প্রত্যাশাও অনেকের।
এমবি
