বাকেরগঞ্জের কারখানা নদীতে বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, আতঙ্কে গ্রাম ছাড়চ্ছেন মানুষ


বাড়িতে মোগ পরিবারের তিনটা টিনের ঘর ছিল। তিনটি ঘরই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঘরের জিনিসপত্রও বের করতে পারি নাই। সব নদীতে চলে গেল! একসময় সব ছিল, এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। বউ-পোলাপান নিয়া এখন শশুড় বাড়িতে আশ্রয় নিছি।
সোমবার কথাগুলো বলেছেন বৃদ্ধ রবজে আলী হাওলাদার (৬০)। তাঁর বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলার ৬নম্বর ফরিদপুর ইউনিয়নে। তিনি নদীতে মাছ ধরতেন। নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে পরিবার নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন রবজে আলী।
স্ত্রী, ছেলেসহ ছয় সদস্যের পরিবার তাঁর।
তিনি জানান, উপজেলায় ৬নম্বর ফরিদপুর ইউনিয়নে বসতবাড়ি ছিল তাঁর। গত ২ বছর আগে নদীভাঙনে বসতভিটা, জমি বিলীন হয়ে গেছে। সব হারিয়ে এখন শশুড় বাড়ি বসতবাড়ি করেন।
শুধু রবজে আলী হাওলাদারই নন, ওই ইউনিয়নে প্রায় ১০-১২ বছর ধরে কারখানা নদী ভাঙনে প্রায় দেড় শতাধিকের অধিক বসতবাড়ি, কৃষি জমি, মসজিদ ও রাস্তাঘাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এই গ্রামের আলম হাওলাদার, ইকবাল খান, দুলাল খান, সবুজ খান, বজলু খান, মোকতার আলী হাওলাদারসহ আরও বেশ কয়েকজন বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অন্যের বাড়িতে বা জায়গায় কোনোরকমে দিন পার করছেন। সহায়-সম্বল হারিয়ে তাঁরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সোমবার সকালে সরেজমিন স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ৬নম্বর ফরিদপুর ইউনিয়নের ডিসিরোড-জনতাহাট প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত কারখানা নদীভাঙনে মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে ভাঙনে দেড় শতাধিকের অধিক বসতবাড়ি ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে শত শত বাড়িঘর। আতঙ্কে দিন পার করছেন মানুষ।
ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে কেউ ঘর সরাচ্ছেন, কেউ গাছ কাটছেন। নদীতে প্রবল স্রোত এবং অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও ইটভাটার কারণে ভাঙন প্রবণতা বেড়েছে। এমতাবস্থায় ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অনেক ক্ষতির শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
তারা বলেন, কেবল অস্থায়ী জিও ব্যাগ দিয়ে এ ভয়াবহ ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ ও দীর্ঘমেয়াদী নদীশাসন প্রকল্প।
ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা মীর হিরন বলেন, কারখানা নদীর অব্যাহত ভাঙনে এই গ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পাঁচ শতাধিক পরিবার সব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার এলাকা ছেড়েছে। সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলোও নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্রুত কারখানার নদীর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানাই।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ মীর মনিরুল ইসলাম, ইউপি সদস্য নাজমুন হাওলাদার, মাসুদ হাওলাদার বলেন, কারখানা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে সড়ক বসত বাড়িসহ ফসলি জমি। সরকারি ভাবে ভাঙন রোধে নেই কোনো কার্যকরী ব্যাবস্থা।
তারা বলেন, বর্তমানে এই গ্রামের আধাকিলোমিটারের মধ্যে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি মাদ্রাসা, তিনটি সাইক্লোন সেন্টার, বাউফল- বাকেরগঞ্জ সংযোগ সেতু, পুরো ইউনিয়ন জুড়ে এল জি ইডি সড়ক, ৮-১০ টি মসজিদ এবং দুটি মন্দির রয়েছে। যা নদীভাঙনে ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফরিদপুর ইউনিয়নের কাকরধা এ কে এম ইন্সটিটিউটের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবুল বাশার বলেন, কারখানা নদী থেকে বিদ্যালয়টি দেড় কিলোমিটার দুরে হলেও ভাঙনে আতঙ্কে আছি। কারণ এখনো নদী ভাঙন রোধে কোন কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এস, এম, শফিকুর রহমান বলেন, নদীর ভাঙনে ফরিদপুর ইউনিয়নের গ্রামের অনেক পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, দূগাপাশা, ফরিদপুর থেকে ৪ থেকে ৫শ’ কিলোমিটার সড়ক নদীভাঙনের ঝুঁকিতে। এখনই যদি ব্যবস্থা নেয়া না হলে আগামী বর্ষায় এই সড়ক নদীভাঙনে বিলিন হয়ে যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় অনেকই ফসলি জমি রক্ষা করতে না পেরে ইটভাটা (ব্রিক ফিল্ডের) কাছে বিক্রি করে দিছে। এ কারণে ও নদীর প্রবল স্রোত এবং অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে কারখানা নদীভাঙনের প্রবণতা আরও বেড়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুমানা আফরোজ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে আলাপ করে নদীভাঙন রোধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, নদীভাঙনের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। এখনো কোন বরাদ্দ পায়নি। বরাদ্দ পেলে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
