১৫ বছরেও সুরক্ষিত হয়নি সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ


‘সিডরের কথা মনে পড়লে শরীর এখনো ঝিমঝিম করে ওঠে। ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কলসের মুখ দিয়ে পানি পড়ছে। সন্ধ্যার দিকে পুরো আকাশটা লাল হয়ে গেছে এবং হাজার হাজার পাখি আকাশে উঠছে। মধ্য রাতে মোর (আমার) ঘরটা বাতাসে জাগাইয়া (তুলে) লইয়া গেল। এক দিকে শো শো বাতাস আরেক দিকে বেড়িবাঁধ থেকে পানির স্রোতে সব কিছুই ভাসাইয়া লইয়া গেছে। সকালে দেখি হাস, মুরগি ও গরু মরা অবস্থায় রইছে। বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে খইরাইন্না ( ভাঙা)। ভাগ্য মোর মোর ভালো মাইয়া, পোলাগো আশ্রয়কেন্দ্রে রাইখ্যা আইছিলাম না হয় ওরা শেষ হইয়া যাইত। সিডর এক রাইতে মোরে ( আমাকে) শেষ করে দিল।’
এভাবেই সিডরের আঘাতের কথা বর্ণনা দেন কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুরের ৫৫ বছরের আছমত। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে পটুয়াখালীর মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে চেনা জনপদ মুহূর্তে পরিণত হয় অচেনা এক ধ্বংসস্তুপে।
১৫ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মহিপুর ইউনিয়নটি এখন মহিপুর থানা হয়েছে। এ জনপদের নেতারা এমপি হয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর। ভাঙা বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছেন বেশ কয়েকবার। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতবার পরিদর্শন করেছেন তার হিসাব দিতে পারছেন না বসবাসকারীরা। কিন্তু সেই ভাঙা বেড়িবাঁধের টিকসই উন্নয়ন হয়নি এখনো।
বছরের পর বছর জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে। যা বর্ষা মৌসুমে ভেঙে পানি প্রবেশ করে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। শত শত একর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা চাষের মৌসুমে ফসল হারানোর ভয়ে থাকে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে অন্যত্র চলে গেছে বেশ কিছু পরিবার।
সরেজমিনে গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথাও বলতে চায় না তারা। মিডিয়াকর্মীদের বক্তব্য দিতে দিতে ক্লান্ত তারা। তাদের ভাষ্য ‘সাংবাদিক আয় ছবি তোলে, ভিডিও করে। মোগো ভাগ্যের তো পরিবর্তন হয় না।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে তারা কোনো লাভ দেখছেন না। প্রলয়ংকারী সিডরের ১৫ বছর পার হলেও সে রাতের ভয়াল দৃশ্য আজও তাড়িয়ে বেড়ায় নিজামপুরবাসীকে।
মো. রহমানের (৫০) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই রাতে ঘরবাড়ি, গাছপালা, ক্ষেতের ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক, বাঁধ সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সিডরের ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও আন্ধারমানিক নদীর মোহনার তীরবর্তী এলাকায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় এখনো দুর্যোগ ঝুঁকিতে দিন পার করছে শত শত পরিবার। হতদরিদ্র পরিবারগুলো সিডরের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি সিডরের এত বছর পরেও।
এদিকে কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার, মহিপুর, চম্পাপুর, লালুয়া ও নীলগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ১৫ কিলোমিটার বাঁধ অরক্ষিত থাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করা পরিবারগুলো রয়েছে এখনো ঝুঁকিতে। গত সপ্তাহে আন্ধারমানিক নদের ভাঙনে ইউনিয়নের জালালপুর গ্রাম সংলগ্ন দীর্ঘ বেড়িবাঁধটির কিছু অংশ নদে বিলীন হয়ে গেছে। যে কোনো সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষকদের দাবি, শিগগিরই টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে হারাতে হবে তাদের আমনধান ও রবিশস্য।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০০৭ সালের সিডরে কলাপাড়া উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৭৮ জন। নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে। উপজেলায় গবাদিপশু মারা গেছে চার হাজার ৯৪৪টি। ক্ষতি হয়েছে ৫৫৩টি নৌযানের। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় কলাপাড়ার ধুলাসার, লালুয়া, মহিপুর, লতাচাপলী ও চম্পাপুর ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে সাগর ও নদীর তীরঘেঁষে প্রায় তিন হাজার পরিবার বসবাস করছে চরম ঝুঁকি নিয়ে।
মহিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী ফজলু গাজী বলেন, ‘এত বড় বেড়িবাঁধ সংস্কার করা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে সম্ভব না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রজেক্ট ছাড়া এ এলাকার বেড়িবাঁধ টেকসই হবে না। ফলে আতঙ্ক আর সমস্যা সমাধানও হবে না। স্থানীয় পর্যায়ে যা করা যায় তা আমরা সবাই করে ফেলছি।’
কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, দ্রুত বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে নতুন প্রজেক্ট শুরু হবে। জালালপুরের বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।’
এসএমএইচ
