তেলাপিয়ার কেজিও ২২০, নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে মাছ


পটুয়াখালীর জালাল উদ্দিন (৬৫)। রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর এলাকার একটি বাসায় দারোয়ানের চাকরি করেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে নিজে খেয়ে-পরে পরিবারের ভরণ-পোষণও চালাতে হয় তাকে। গত তিন বছরে এক টাকাও বেতন বাড়েনি। অথচ প্রতিদিনই বাড়ছে জীবন নির্বাহের ব্যয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়ায় দু-বেলা ডাল-ভাতের জোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন জালাল উদ্দিন। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে তার মতো সীমিত আয়ের সব মানুষের চোখে এখন কেবলই সর্ষেফুল।
রোববার (১৪ আগস্ট) মিরপুর-১ নম্বরে শাহআলী কাঁচাবাজারে এসেছিলেন জালাল। বেশ কিছুক্ষণ এ-দোকান ও-দোকান ঘুরাঘুরি করে সব থেকে কম দামে অর্থাৎ ২২০ টাকা কেজি দরে এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনে ফিরেছেন তিনি। দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে একই মাছের দাম ছিল ১৭০-১৮০ টাকা কেজি। বেতন না বাড়লেও কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেশি দিয়ে মাছ কিনতে হয়েছে জালাল উদ্দিনকে।
সরেজমিনে ওই বাজারে জালাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, তেলাপিয়া ২২০ টাকা কেজি দরে কিনলাম। আগের চেয়ে কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেড়ে গেছে। বর্তমান বাজারে আমাদের মতো মানুষের টিকে থাকা খুব কঠিন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে আমদানি কম ও পরিবহন খরচ বাড়ায় মাছের দাম বেড়েছে। মাঠের এ মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন জালালের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা। এদিন বাজার ঘুরে নিম্নআয়ের অনেক ক্রেতাকে মাছ না কিনেই ফিরে যেতে দেখা গেছে।
খাদ্য রসিক বাঙালির পছন্দের তালিকায় সবার উপরে মাছ। তবে বাজারে পর্যাপ্ত জোগান না থাকায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ ভোগ্যপণ্যটি। সকাল থেকেই মিরপুরের ওই বাজারটিতে নানা জাতের মাছের দেখা মেলে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও দেশীয় অন্যান্য জাতের মাছও দেখা যায় বাজারে। তবে সব মাছই ছিল পরিমাণে কম। তেলাপিয়া, বাটা, পোনা, পুটিসহ অন্য মাছগুলোরও জোগান দিতে পারছেন মৎস্যজীবীরা। রুই, কাতলাসহ সামুদ্রিক বড় মাছের জোগান কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও তুলনামূলক অনেক বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাষের মাছ কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা থেকে হঠাৎই ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। দেশীয় ছোট জাতের মাছ কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
বাজারে ছোট দেশি চিংড়ি ৬০০, বড় কাতলা ৫০০, দেশি কই ৫০০, দেশি শিং ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া প্রতিকেজি শোল মাছ ৭০০, দেশি টেংরা ৬০০, আইড় ৯০০ থেকে ১০০০ ও বাইম মাছ এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দেশি মাছ বিক্রেতা মোহাম্মদ জনি বলেন, আমরা সবসময় দেশি মাছ বিক্রি করি। পাইকারি বাজারে বর্তমানে কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়তি। জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। শুধু মাছ নয়, অন্য সব পণ্যের দাম বেড়েছে। পরিবহন খরচ বাড়ায় আমদানি কম। আর এ কারণে বাজারে জোগানও কম। তাই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে বাধ্য।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি বড় সরপুঁটি মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকায়, ২০ টাকা বেড়ে মাঝারি সরপুঁটির কেজি ২০০, ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে শোল মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, প্রতি কেজি বোয়াল ৫৫০ থেকে ৭০০, রুই ৩০০ থেকে ৩৩০, সিলভার ১৬০ থেকে ১৭০, পাঙ্গাস ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি ৪০ টাকা বেড়ে ছোট কাচকি মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা দরে। বাজারে বড় রুপচাঁদার কেজি এক হাজার ৪০০ টাকা আর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশও কেজিতে একই দামে বিক্রি হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, মাছের উৎপাদন ও আমদানি ঠিকই আছে। মূলত পরিবহন খরচ বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে মাছসহ অন্য সব নিত্যপণ্যের দামে।
মাছের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আতিয়ার রহমান বলেন, মাছের উৎপাদন কম হওয়ার কারণ নেই। সব জিনিসের দাম বেড়েছে। মাছের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। কারণ, মাছ চাষিরাও মাছের ওপর নির্ভরশীল। তাদের পরিবারও চলে মাছ বিক্রি করে।
সাগরে মাছ কম ধরা পড়ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাছের মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ আসে সাগর থেকে। বাকি ৮৫ শতাংশ আমাদের পুকুর ও খাল-বিল থেকে। ফলে সাগরে মাছ কম বা বেশি ধরা পড়ার সঙ্গে দাম বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সাগরে মাছ কম ধরা পড়ছে না। পরিবহন খরচসহ অন্যান্য সব পণ্যের দাম বাড়ায় মাছের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
এইচকেআর
