চাদ এখন কোন পথে?


চাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবির মৃত্যু ঘিরে দেশটির রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। ইদ্রিস ডেবির মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিস ডেবি কাকার নেতৃত্বে সামরিক কাউন্সিল মধ্য আফ্রিকার এই দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে চাদে সামরিক কাউন্সিল ক্ষমতা গ্রহণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। গত মঙ্গলবার সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তবে দেশটির ক্ষমতার পরিবর্তন ঘিরে পশ্চিমাদের মনোভাবে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। চাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি কেউ আফ্রিকার মাঝবরাবর একটি রেখা আঁকেন, তবে তা এমন একটি অঞ্চল অতিক্রম করবে, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতা চলছে। এর মধ্যে রয়েছে সোমালিয়ার আভ্যন্তরীণ লড়াই থেকে শুরু করে সাহেলের জিহাদিদের বিদ্রোহ পর্যন্ত। এ রেখার মধ্যবিন্দুতে পড়বে চাদ। দেশটি যেন আগুনের কুণ্ডলীতে ঘেরা একটি বারুদের পিপা। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। চাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি প্রায় ৩০ বছর ধরে চাদকে এ বিস্ফোরণ থেকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ডেবি আর নেই। গত ২০ এপ্রিল দেশটির সেনাবাহিনী জানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে আঘাত পেয়ে নিহত হয়েছেন ডেবি। তিনি দেশটির রাজধানী এনজামিনার দিকে আগুয়ান বিদ্রোহীদের দমনে নিজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরপরই তাঁর ছেলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির ক্ষমতায় এসেছেন।
এতে ওই অঞ্চল নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের মতো দেশের আফ্রিকান ক্ষমতাশালী নেতাদের সমর্থনের নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। দেশটির সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর ক্ষমতা পার্লামেন্টে নির্বাচিত নেতার হাতে যাওয়ার কথা। কিন্তু এর পরিবর্তে সেনাবাহিনীর বিশেষ কাউন্সিল ক্ষমতা নেয়। এর প্রধান ইদ্রিস ডেবির ৩৭ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিস ডেবি।
অভ্যুত্থানবিরোধী নীতি নিয়ে চলা আফ্রিকান ইউনিয়নও এ ঘটনায় কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বে চাদের প্রধান মিত্র ফ্রান্সও চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, সব ধরনের বিক্ষোভের ওপর সামরিক বাহিনী নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর বিক্ষোভের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বিক্ষোভে নামার আহ্বান জানায় বিরোধী দলগুলো। গত সোমবার আলবার্ট পাহিমি পাদাককে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সামরিক কাউন্সিল। ইদ্রিস ডেবির অধীনে একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তবে বিরোধী দলগুলো দেশটিতে পুরোপুরি বেসামরিক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে।
৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন ইদ্রিস ডেবি। ১১ এপ্রিল দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণার এক দিন পর তাঁর মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়। ৭৯ শতাংশ ভোট পান তিনি। বেঁচে থাকলে তিনি ষষ্ঠবারের মতো ক্ষমতায় আসতেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে দমন–পীড়নের অভিযোগ তুলে বিরোধীদের বেশির ভাগই নির্বাচন বর্জন করেছিল।
ইকোনমিস্ট বলছে, চাদে বিশাল ফরাসি সেনা ঘাঁটি রয়েছে। সাহেলের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে ৫ হাজার ১০০ সেনা রয়েছে। সেখানে সাহেলের ইসলামিক স্টেট বা আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়তে ফ্রান্স যখন মিত্র খুঁজছিল, তখন সাড়া দেয় চাদ। দেশটির শাসক ইদ্রিস ডেবি ১ হাজার ২০০ সেনা নাইজার, মালি ও বুরকিনা ফাসো সীমান্তে পাঠায়।
যেখানে গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই পরবর্তী স্বৈরশাসকে সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে চাদের বন্ধুদের উচিত সরকার ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করা।
ইদ্রিস ডেবির ক্ষমতায় আসার আগে চাদের সাবেক স্বৈরশাসক হিসেবে হাবরে নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ১৯৮২ সালে পশ্চিমাদের মদদে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আট বছর ক্ষমতায় ছিলেন। কথিত আছে, দেশটির ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। বন্দীদের অনেকেই ‘লা পিসকিন’ নামের মাটির নিচের এক কারাগারে মারা গেছেন। মাটির নিচের একটি সুইমিং পুলকে কারাগার বানিয়ে সেখানে নির্যাতন, ধর্ষণ ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিদ্রোহীদের। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর পক্ষে ছিল। রোনাল্ড রিগ্যান হাবরেকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর ‘স্বাধীনতা প্রতিশ্রুতির’ প্রশংসা করেছিলেন।
হাবরের সরকারকে উৎখাত করেছিলেন ডেবি। তাঁর অধীনে দেশটির গোপন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নৃশংসতা কম করলেও পুরোপুরি বন্ধ করেননি। ডেবির অনেক বিরোধীকে নির্যাতন করা হয়েছে। কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছে। অনেক নির্বাচন কৌশলে নিজের পক্ষে এনেছেন তিনি। তবে তিনি ফ্রান্সের কাছ থেকে যে সমর্থন পেয়ে আসছেন, তা এ ধরনের ঘটনায় কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং তাঁর পক্ষ হয়ে ফ্রান্স বিদ্রোহীদের ওপর ২০১৯ সালে বোমাবর্ষণ করেছে।
ডেবির মৃত্যুর পর ফ্রান্স সরকার বলেছে, তারা ‘একজন সাহসী বন্ধু’কে হারিয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা হস্তান্তরের নিন্দা করার পরিবর্তে ফ্রান্সের কর্মকর্তারা চাদের স্থিতিশীলতা রক্ষায় তাঁদের সমর্থনের কথা বলেছেন। নাইজেরিয়া সরকারও একই ধরনের মনোভাব দেখিয়েছে। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য হলো চাদের স্থিতিশীলতা এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য গণতন্ত্র অর্জন করা।
তবে ইকোনমিস্ট বলছে, এ দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্পমেয়াদি। দেশটিতে গণতন্ত্র না থাকায় চাদের বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশটি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা এখন রাজধানী থেকে ৩০০ কিলোমিটারের কম দূরে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, দেশটির সেনাবাহিনী আরও বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। সেখানে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। অনেকেই লিবিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে চাদের তুলনা করছেন।
যেখানে গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই পরবর্তী স্বৈরশাসকে সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে চাদের বন্ধুদের উচিত সরকার ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করা। বিশেষ করে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেশটির সংবিধান অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
/ইই
