ঢাকা-প্যারিস বাণিজ্য দ্বিগুণ করার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ফরাসি ব্যবসায়ীদের ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর কৌশলগত অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার (১০ নভেম্বর) ফ্রান্সে এমইডিইএফ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে ফরাসি বিনিয়োগ এখনও তার বৈশ্বিক বিনিয়োগের তুলনায় কম। আমি ফরাসি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক সংযোগ কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য কাজ করছি। সড়ক, রেল, সমুদ্র, জ্বালানি ও ডিজিটাল সংযোগ ক্ষেত্রে অঞ্চল জুড়ে আমাদের বিনিয়োগ হবে প্রকৃত পট-পরিবর্তক ।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সরাসরি তার অফিসের সঙ্গে সংযোগ রেখে কাজ করছে এবং সম্ভাব্য যে কোনো উপায়ে তার কার্যালয় ফরাসি বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করতে পারলে খুশি হবে।
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আপনার প্রবেশ সহজ করার জন্য আপনি একজন স্থানীয় অংশীদার খুঁজতে পারেন এবং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সাথে একটি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা হবে আপনার জন্য উত্তম।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।’
ফ্রান্স এখন বাংলাদেশের পঞ্চ বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ করার লক্ষ্য রাখতে হবে। ফ্রান্সে আমাদের রপ্তানি আরও বৈচিত্রময় হওয়া চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি নিশ্চিত যে ফরাসি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগে উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনা সম্পর্কে আস্থবান হবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় আপনাদের সার্বক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও পরামর্শকে স্বাগত জানাব। বাংলাদেশ পারস্পরিক সুবিধার জন্য আপনাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের বিকাশে আপনাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।’
তিনি বাংলাদেশ-ফ্রান্স বিজনেস কাউন্সিল গঠনের জন্য এমইডিইএফ’কে ধন্যবাদ জানান।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগের মাধ্যমে আরও দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করব। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের পরের বছর বাংলাদেশে এমইডিইএফ ব্যবসায়িক মিশন পরিকল্পনা করা যেতে পারে।’
প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ এবং ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার গতকালের আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা দ্বিপক্ষীয়ক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন।
তিনি যোগ করেন, ‘এটি আমাদের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বেও প্রতিফলিত হতে হবে। আমি এর জন্য আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতার প্রত্যাশা করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০১৮-১৯ সালে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এমনকি কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন অর্থনীতি ৫ দশমিক ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছে, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের জীবন এবং জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আমাদের কৌশল আমাদের পক্ষে কাজ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের ৩১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি এখন নামমাত্র জিডিপিতে বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম এবং মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সামষ্টিক-অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলি শক্তিশালী রয়েছে এবং ইতিবাচক সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং পেতে চলেছে। আমাদের সিকিউরিটিজ মার্কেটও আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জন করছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতির ফল।
তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মোকাবেলা, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিনামূল্যে আবাসন বরাদ্দ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক সুরক্ষায় আমাদের অর্জন এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।’
তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্য আগামী বছরের মার্চের মধ্যে টার্গেট গোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনা। আমি মহামারী থেকে আরও ভালো, শক্তিশালী এবং সবুজকে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সংহতির আহ্বান জানাই।
তিনি বলেন, সরকার শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। আমাদের বেসরকারি খাত অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা দেখাচ্ছে। আমাদের দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্ত ভোক্তা শ্রেণি আছে। আমাদের বালিকারা এবং মহিলারা সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী প্রজন্মকে সত্যিকারের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আইটি ফ্রিল্যান্সার এখন বাংলাদেশে কাজ করছে। আমাদের কিছু স্টার্ট-আপ বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। আমাদের কিছু প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমাদের এলাকা এখন তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, মহামারী অবকাঠামো প্রকল্পে বাংলাদেশের বিশাল বিনিয়োগকে ধীর করতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমরা এই অঞ্চলে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের পরিবেশও অফার করি। আমরা আমাদের আইনি এবং নীতি কাঠামোতে টেকসই সংস্কারের জন্য উন্মুক্ত। আমাদের আইনি ব্যবস্থা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। আমরা আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর নীতিগত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, সরকার সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাই-টেক পার্ক স্থাপন করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এখন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের সমগ্র ভূখণ্ডে ইন্টারনেট কভারেজে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন ধান, অভ্যন্তরীণ মৎস্য ও সবজি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। আমাদের সুনীল অর্থনীতির সম্পদ অবশ্য অনেকাংশে অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকি আমাদের একটি বাস্তবতা। কিন্তু আমরা এখন জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং স্থায়িত্ব তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছি।’
তিনি আরও বলেন,‘এটি আমাদের অংশীদারদের জন্য সবুজ ব্যবসার সুযোগ তৈরি করছে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য একটি শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ গড়ে তোলা।’
তিনি বলেন, এসব কারণ বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের গন্তব্যে পরিণত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে প্যারিসে যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘ফ্রান্সকে তার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দ্রুত করার জন্য বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রয়োজন। একসাথে, আমরা আমাদের দুটি অর্থনীতির জন্য একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি।’
তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ‘আমরা একটি ফরাসি কোম্পানির প্রযুক্তিগত সহায়তায় আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরি করেছি। দুটি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে। আমরা আমাদের দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের পরিকল্পনা শুরু করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের এয়ার নেভিগেশন সিস্টেম ফরাসি প্রযুক্তি দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে এবং এছাড়াও আমাদের তেল শোধনাগারগুলির একটি সম্প্রসারণসহ জ্বালানি খাতে ফরাসি দক্ষতাও ব্যবহার করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আমাদের পানি উন্নয়ন খাতে ক্রমাগত ফরাসি বিনিয়োগের প্রশংসা করি। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ বর্ধিত সহযোগিতার জন্য আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে।
এমবি
