২০ বছর ধরে পথে পথে ঘুরছেন জনপ্রিয় সেই শিক্ষক


নাম তার কাজী আব্দুল গাফ্ফার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসি পাস করে মানিকনগর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে ফিরে যান নিজ জেলা ঝিনাইদহে। মহেশপুরে ফিরে আসার পর তার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ২০ বছর ধরে পথে পথে ঘুরছেন।
একজন মেধাবী শিক্ষকের এমন পরিণতি ও জীবনদশা দেখে পরিচিতজনরা হতবাক হলেও তার চিকিৎসার দায়িত্বে কেউ এগিয়ে আসেনি। ময়লা, ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। রাত কাটান মসজিদ, স্কুল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায়।
সরোজমিনে দেখা যায়, কাজী আব্দুল গাফফার ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার এসবিকে ইউনিয়নের গোয়ালহুদা গ্রামের মসজিদের পাশে একটি টং ঘরে শামীম রেজা নামে এক ছাত্রকে পড়াচ্ছেন। পরে সেখান থেকে জানা যায়, এলাকায় গণিত ও ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় তিনি। বীজ গণিতের উৎপাদক বিশ্লেষণের ফর্মুলা আবিষ্কার করে হৈ চৈ ফেলে দেওয়া সেই শিক্ষকের দিন কাটে মসজিদ ও অন্যের কুটুরি ঘরে। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। গায়ে দুর্গন্ধময় ময়লা কাপড়। মাথাভর্তি আউলা ঝাউলা চুল।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার খামারাইল গ্রামের কাজী আব্দুল কুদ্দুসের বড় ছেলে তিনি। তার মেজ ভাই কাজী আব্দুল গনি নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ছোট ভাই কাজী আব্দুল কাদের ঢাকায় আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। তিন ভাই আর দুই বোনকে নিয়ে মা চলে আসেন মহেশপুর পৌর এলাকার জলিলপুর মোল্লা পাড়ায় নানার বাড়িতে। নানা নুরুদ্দীন আহম্মেদের বাড়িতে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন আব্দুল গাফ্ফার। বেড়ে ওঠেন তুখোড় মেধাবী ছাত্র হিসেবে। এলাকায় তার মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে।
মা বদরুন্নেছা আবারও নতুন জীবন শুরু করেন। আব্দুল গাফ্ফাররা নানা বাড়ি থেকেই বড় হতে থাকেন। তিনি বিয়ে করেন নড়াইলে। তার স্ত্রী ছিলেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আর সংসার করা হয়নি। ৩০ বছর ঢাকায় বসবাসের পর তিনি মহেশপুর চলে আসেন।
খালিশপুর গোয়ালহুদা গ্রামের শাহিনুর রহমান বলেন, তিনি দীর্ঘ ১০/১৫ বছর ধরে আমার এখানেই থাকেন। আমার দুই বোন ও ছোট এক ভাই তার কাছে পড়ে এসএসসি, এইচএসসি ও অনার্স পাস করেছে। স্যারের কাছে এখনো অনেক ছাত্র পড়েন। তিনি সারাদিন বাইরে বাইরে ঘোরেন, রাতে এখানে থাকেন। তার ভাইয়েরা বেশ কয়েকবার এখন থেকে নিতে এসেছেন, কিন্তু তিনি যাননি। তার ঢাকা ও গ্রামের বাড়িতে অনেক জমি আছে শুনেছি।
শামীম রেজা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি স্যারের কাছে দীর্ঘ ৪ বছর ধরে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করে আসছি। প্রথমে আমার বড় আপু পড়তেন। এরপর আমি জাদুর ছক শিখতে আসছিলাম। সেখান থেকেই স্যারের সঙ্গে পরিচয়। আমি স্যারের ওষুধ, খাবার এনে দেই, প্রস্রাব-পায়খানা করার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
কথা হয় কাজী আব্দুল গাফ্ফারের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোন সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসি পাস করেছি বলতে পারবো না। এমএসসি পাস করার পর গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে ঢাকার মানিকনগর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছি। এরপর হেঁটে হেঁটে ঢাকা থেকে এখানে চলে এসেছি।
আমি সারা জীবন এতিম ছিলাম। আমার বাবা ঝিনাইদহ সদর উপজেলার খামারাইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। মেজ ভাই কাজী আব্দুল গনি সচিব, ছোট ভাই কাজী আব্দুল কাদের অ্যাডভোকেট। ছোট ভাই আমার জায়গা-জমি দেখাশুনা করে। তার সঙ্গে বনিবনা হয় না। যে কারণে আমার সম্পদের কোনো হিসাব নেই।
কাজী আব্দুল গাফ্ফার আপনি এমন পরিবেশে কেন থাকেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এখন আর থাকার সময় নেই। চলে যাওয়ার সময় এসেছে। আমার একটাই ম্যাসেজ জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলবে না।
১ নং এসবিকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আরিফান হাসান চৌধুরী নুথান বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে থাকতে দেখে আমরা হতভম্ভ হয়েছি। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক। দীর্ঘ দিন ধরে আমার এই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে হেঁটে বেড়ান এবং মসজিদে থাকেন। এ ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ ১৫/২০ বছর ধরে পড়াশুনা করিয়ে আসছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাকে বাড়িতে ফেরানোর, কিন্তু তিনি বাড়িতে ফিরে যেতে চান না।
/ইই
