বাজারে সব পণ্যের দামে আগুন


একমাস কাজ কইরা টাকা পাইয়া রূপাতলী কাঁচা বাজারে আইছিলাম গরুর মাংস কিনতে। দোকানে গিয়া হুনি গোশতর কেজি ৮০০ টাহা। তহন দোকানদারের কাছে এক পোয়া মাংস চাইছি, কিন্তু এটুকু মাংস বিক্রি করে না। কি আর কমু, ডিম নিয়া বাড়ি ফিরছি।’
শুক্রবার সকালে রূপাতলী এলাকার বাজারে দেখা হলে প্রতিবেদকের সাথে এমই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেছেন শরবানু বেগম (৭৫)।
তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে মেয়ে তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমি ভাসানি সড়কে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কলেজের পোলাপাইনের ম্যাচে রান্না কইরা দি। এরপর সারাদিন পর আইয়া আল,ু ডাইল যা থাহে, তা রান্না কইরা খাই। অনেক সময় পানি ভাতও খাই। মাস শেষ হওয়ার আশায় থাহি, বেতনের টাহা কয়ডা পামু। আর বাজারে যাইয়া ভালো মন্দ কিনমু। কিন্তু এত্তো দামের কারণে আর অয় না।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শরবানুর মত অবস্থা অধিকাংশ ক্রেতার। সাধ্যের মধ্যে ভরছে না তাদের বাজারের ব্যাগ। মাছ-মাংস, শাক-সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দামে দারুণ বিপাকে সাধারণ ক্রেতারা। বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। বাধ্য হয়ে পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন তারা।
আলমগীর হোসেন নামে এক যুবক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেতনের টাকায় পরিবার নিয়ে বাঁচা দায়। এর মধ্যে প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন পণ্যর দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে এসে পণ্যের দামের কথা শুনলে মনে হয়, না কিনে ফিরে যাই। ব্যবসায়ীরা এক কেজির নিচে কোন কিছুই বিক্রি করতে চায় না। আধা কেজি বিক্রি করলেও দাম বেশি নেয়।
শহরের বাংলাবাজার, পোর্ট রোড বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার খোলা চিনির দাম কেজি প্রতি ১২০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১২৫ টাকা নির্ধারিত করলেও ১৪০ টাকার কম কোথাও খোলা চিনি মিলছে না। এক সপ্তাহ আগে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যা আগে ছিল ১৮৭ টাকা। তবে নতুন দামের তেল এখনো আসেনি সবখানে। কিন্তু পুরোনো দাম লেখা মোড়কের বোতলও বাজারে বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মোড়কে দাম ১৮৭ টাকা লেখা, অথচ সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। ৩৭৪ টাকার দুই লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৩৯০ টাকায় এবং ৯০৬ টাকার ৫ লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৯১৫-৯২০ টাকায়।
মসলার বাজারে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম। ঈদের পর থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩০-৩৫ টাকা বেড়ে এখন ৭০ টাকায় ঠেকেছে। যা দুদিন আগেও ৬০-৬৫ টাকা ছিল। অন্যদিকে আমদানি করা চীনা রসুনের কেজি প্রতি দাম ২০ টাকা ৩০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা।
বাংলাবাজারের মুদি ব্যবসায়ি লিটন বলেন, মোকাম দিয়া পণ্যর দাম বাড়তি রাখা হয়। সেখানে ক্রেতাদের কাছে আমাগোও বাড়তি দাম ছাড়া বিক্রি করা ছাড়া উপায় আছে। তার মধ্যে নিত্যপণ্য খুরচা বা একপোয়া এইভাবে কি বিক্রি করা যায়? তিনি বলেন, যে ভাবে দাম বাড়ছে তাতে খেটে খাওয়া মানুষের এইভাবে কেনা ছাড়াতো উপায়ও নাই। কিন্তু আমাগো মত ছোট খাটো ব্যবসায়ীরা এভাবে বিক্রিও করতে পারছি না।
সবজি ও মাছের বাজারও পুড়ছে বাড়তি দামের আগুনে। বাজারে এখন আলু ছাড়া অন্য কোনো সবজির কেজি ৬০ টাকার কমে মিলছে না। পেঁপে ও মুলার মতো তুলনামূলক কম চাহিদার সবজির কেজিও উঠেছে ৮০ টাকায়। যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খুবই অস্বাভাবিক। এতদিন কমের মধ্যে থাকলেও মোটা দাগে দারুণ অস্বস্তি এখন সবজির বাজারে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলুর দাম গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। গত দু-তিন দিনের ব্যবধানে নতুন করে সবজির দাম বেড়েছে। এখন বাজারে প্রতি কেজি বেগুন, পটল, মুলা, বিক্রি হচ্ছে ৬০৭০ টাকা, ঝিঙে, ধুন্দল, করলা, কাকরোল, বরবটি, ভেন্ডি, চিচিঙ্গা ৮০-১০০ টাকা, সজনে ডাটা ১২০ টাকায়।
বাজারে ২২০ টাকা কেজির কমে তেলাপিয়া বা পাঙ্গাস মাছও কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। চাষের রুই-কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩৫০ টাকায়। আর দেশি উন্মুক্ত জলাশয়ের শিং, টেংরা, বোয়াল খেতে গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
পোর্ট রোড বাজারের মাছ বিক্রেতা লিটন বলেন, ঈদের কিছুদিন পর থেকে মাছের চাহিদা বেড়েছে। তখন থেকেই প্রতিদিনই আড়তে মাছের দাম বাড়তির দিকে। বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন মাছের দাম কেজিতে ৫০-১০০ টাকা বেশি।
অন্যদিকে বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৩০ টাকার মধ্যে। আর প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৪০ টাকা। এছাড়া গরুর মাংস ৮০০ ও খাসির মাংস ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এইচকেআর
