দেশের মানুষকে ভাতে মারছে, পানিতে মারছে : ফখরুল


দেশের রিজার্ভ সংকটের জন্য আবারও সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ রিজার্ভ চিবিয়ে নয়, গিলেই খেয়ে ফেলেছে।’
শনিবার (২৬ নভেম্বর) কুমিল্লা টাউন হল প্রাঙ্গণে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ৩৫ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যেই আজকের এই সমাবেশ। আমি দুঃখ ভারাক্রান্তে বলছি, বিনা কারণে আমাদের ভাই, আমাদের ছেলেকে হত্যা করেছে। আজকে সমগ্র বাংলাদেশে শোকের আগুন। আজ তারা দেশের মানুষকে ভাতে মারছে, পানিতে মারছে। আজ দেশের মানুষ এই জালিম সরকারের পতন চায়।’
তিনি বলেন, ‘এই কুমিল্লা মেধার জায়গা। এই কুমিল্লায় বড় বড় গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে। আমি বলতে চাই, আখতার হামিদ খানের কথা। যিনি তিন ফসলের চাষ শিখিয়েছেন। আপনারা সেই ইতিহাসের সেই গৌরবময় ধারক। আমি স্মরণ করতে চাই অলি আহাদ, কাজী জাফর ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে।’
আওয়ামী লীগের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, ‘তারা জোর করে দুবার নির্বাচন করেছে। ২০১৪ সালে কেউ ভোট দিতে যায়নি। ২০১৮-তে আগের রাতে ব্যালটবক্স ভর্তি করেছে। তিনি (শেখ হাসিনা) নাকি আবার নির্বাচন করতে চান। ভুলে যান, এসব ভুলে যান।’
আব্বাস উদ্দিনের গানের কথা বলে ফখরুল বলেন, ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। মানুষ আর ভাঙা নৌকায় চড়বে না। সময় থাকতে আগে আগে কেটে পড়ুন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধ, প্রেমময় বাংলাদেশ দেখার জন্য এদেশ স্বাধীন করেছিলাম। কিন্তু আজ আবার এদেশে প্রহসন চলছে। আপনারা ক্ষমতায় এসে যেমন খুশি তেমন চুরি করবেন। এত অত্যাচার। এদের লজ্জাও নেই, শরমও নেই। এদের চামড়া গণ্ডারের মতো মোটা হয়ে গেছে। ১০ তারিখের সমাবেশ বন্ধ করার জন্য ঘরে ঘরে মামলা দিচ্ছে। রেইড দিচ্ছে। কিন্তু ঢাকার সমাবেশ বন্ধ করা যাবে না। যেমনটা আগের সমাবেশ বন্ধ করা যায়নি। তারা আগে বলেছিল, ঢাকায় সমাবেশ করা যাবে না। এরপর পূর্বাচল থেকে সোহরাওয়ার্দী আসলেন। একটু এগিয়ে এবার পল্টনে আসুন।’
ফখরুল বলেন, ‘তারা দেশকে খুবলে খেয়েছে। তারা রিজার্ভ চিবিয়ে খাননি, গিলেই খেয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশ থেকে গত দশ বছরে ৮৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত ১০ বছর ক্ষমতায় কারা ছিল? বিদ্যুতের দাম তারা আবার বাড়িয়েছে। আর কত বাড়াবেন? একটা জিনিসও নাই, যেটার দাম বাড়ানো হয়নি। কারও বেতন বাড়েনি। ওদের টাকা বেড়েছে। ওরা ফুলে মোটা হয়ে গেছে। কোথাও কিছু রাখেনি। কেউ ন্যায়বিচার পায় না। সবার বিরুদ্ধে মামলা। যেভাবে খালেদা জিয়াকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তারা এ দেশের কারান্তরীণ করে রেখেছে। আমরা বলতে চাই, নতুন কমিশন গঠন করে নির্বাচন দিতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কেউ নির্বাচনে যাব না।’
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন-উর-রশিদ ইয়াছিনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, `সরকার ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য আমাদের ছাত্রনেতা নয়নকে হত্যা করেছে। আপনারা সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সমাবেশকে সফল করেছেন। তাই বৃহত্তর কুমিল্লাবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। এটা টাউন হলের সমাবেশ নয়, এটা কুমিল্লা শহরের সমাবেশে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। শুধু পার্লামেন্ট নয়, গত ১৪ বছর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সরকার ৬০০-এর বেশি গুম করেছে, এক হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এক লাখ মামলা হয়েছে। তারা আমাদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায়।'
তিনি বলেন, আজ অর্থনীতি খাদের কিনারায়। আজ মধ্যবিত্ত গরিব হয়েছে। গরিব আধপেটা খেয়ে থাকছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এই কুমিল্লা ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা। সরকার এই কুমিল্লাকে পছন্দ করে না। তাই নানাভাবে অপঘাত করছে। কুমিল্লার মানুষ কুমিল্লা নামেই বিভাগ চায়। বিভাগ অন্য নামে হলে কুমিল্লার মানুষ প্রত্যাখ্যান করবে। সরকার যে নামেই বিভাগ করুক, আমরা এসে কুমিল্লা নামেই বিভাগ করব। এই সরকারের পতন ১০ তারিখের পরেই হবে।’
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আপনাদের এই বিশাল সমাবেশ সরকারের হৃৎকম্পন শুরু করেছে। তারা আবোলতাবোল বকছে। তারা এখানে হরতাল ধর্মঘট করেনি। কিন্তু জুলুম-নিপীড়ন করেছে। এই নয়নের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। এই নয়নের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করব। গোটা এশিয়া মহাদেশের চেয়ে দেশে গরুর মাংসের দাম বেশি। সব পণ্যের দাম এমন বেড়েছে, তা ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। কিছু বললে, তারা আমাদের কর্মীদের গুলি করে মেরে ফেলেছে। তারা আমাদের আটজনকে হত্যা করেছে। ঢাকা-ময়নমনসিংহ মহাসড়কের জায়গা দেখিয়ে তারা ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি লুট করেছে। তাদের কর্মীরা হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। দেখা যাক, জনগণ আপনাদের পছন্দ করে, নাকি খালেদাকে পছন্দ করে।’
এদিকে সমাবেশে বাবার খোঁজ চান গুম হওয়া সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলাম ও হুমায়ূনের ছেলে শাহরিয়ার হোসেন। সন্তান হত্যার বিচার চান ছাত্রদল নেতা নয়নের বাবাও।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়ন হত্যার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। তার নাকি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা। তিনি যশোরে একটি সমাবেশ করেছেন। বিএনপির আগের সাতটি সমাবেশের জবাব দিয়েছেন, অথচ কুমিল্লার একটি সমাবেশ তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। আমি এই কুমিল্লাকে চিনতে পারছি না। এত মানুষ! কুমিল্লা আজ লোকে লোকারণ্য। আমরা কোনো গুম-খুন হত্যাকে ভয় পাই না। আমরা আটটি সমাবেশ করে জানিয়ে দিলাম, এ দেশের জনগণ আপনাদের না। কালো কোর্ট পরে আপনারা চুরির ধান্দা করেন। একবার আট হাজার কোটি টাকা, একবার নয় হাজার কোটি পাচার করলেন। এখন বলছেন দুর্ভিক্ষ আসতে পারে। আপনারা দুর্ভিক্ষ ঠেকাবেন কী দিয়ে? টাকা তো পাচার হয়ে গেছে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির যে সংকট, এ সংকট তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। যারা চার লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে, তাদের নাম সরকার প্রচার করে না। দুদক রেজিস্ট্রার অফিসের পিয়নকে খোঁজে, তাদের খোঁজে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এত বিদ্যুৎ কোথায় রাখব? আজ বিদ্যুৎ কোথায়? সব লুণ্ঠন করে নিয়েছে। যাদের দেশপ্রেম নেই, তাদের ইমান নেই। শেখ হাসিনা সরকারের লুটেরাদের ঈমান নেই। এই লুটেরাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, ‘গত ১৪ বছর অনেক কষ্ট সহ্য করেছে এ দেশের মানুষ। যখন বিএনপি ভালো থাকে, তখন বাংলাদেশ খারাপ থাকে। গত ১৪ বছর বিএনপি ভালো ছিল না। দেশের মানুষও ভালো ছিল না।’
গত সাতটি সমাবেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওরা নৌকা বন্ধ করে দেয়, বাস বন্ধ করে দেয়, জনগণকে আটকাইতে পারে না। এদেশের মানুষ বন্দুকের নলকে ভয় পায় না। এই গণসমাবেশে গণজোয়ারই তার প্রমাণ।’
রুমিন ফারহানা বলেন, ‘১২ বছর ধরে শুনছি উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষায় আসল দুর্ভিক্ষ! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলছি, সাবধান হয়ে যান। আপনারা এ দেশেরই সন্তান। দেশের মানুষের দিকে বন্দুক তাক করবেন না।’
এর আগে শনিবার বেলা ১১টার দিকে গণসমাবেশের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। তিনদিন আগে থেকেই চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার মানুষজন আসতে শুরু করেন। শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে লোকারণ্য হয়ে ওঠে টাউন হল প্রাঙ্গণ।
এএজে
