মুক্তিপণের টাকায় ব্যবসার ইচ্ছে ছিল ল্যাংড়া মামুনের
মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া মামুন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা হারালেও অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন। ভগ্নিপতির টাকা আত্মসাৎ করে পটুয়াখালী শহরে একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তিনি। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। তার রয়েছে দুটি টর্চার সেলও। পটুয়াখালীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শিবু লালকে অপহরণও করেন এই ল্যাংড়া মামুন।
মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবু লাল দাসকে অপহরণের মূলহোতা ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি গুলশান বিভাগ।
গ্রেপ্তার হওয়া অন্য ব্যক্তিরা হলেন, ল্যাংড়া মামুনের সহযোগী পিচ্চি রানা, বিআরটিসির গাড়িচালক জসীম উদ্দীন এবং রেন্ট-এ-কারের দালাল আশিকুর রহমান।
এসময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছা ও চার হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কে.এম হাফিজ আক্তার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ, ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান।
এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, নানা অপকৌশলে পটুয়াখালী জেলা শহরে মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান মামুন। তার অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এলাকায় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া এবং বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন মামুন।
অপহরণের শিকার শিবু লাল দাস পটুয়াখালী জেলা শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি ঠিকাদারিসহ বিভিন্ন ব্যবসায় সম্পৃক্ত। অপর ভিকটিম মিরাজ মিয়া পাজেরো জিপের চালক। গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে শিবু লাল দাস গলাচিপায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের গাড়িতে করে পটুয়াখালী শহরের বাসায় ফেরার পথে ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হন। পরে দূরের একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি পরিত্যক্ত অবস্থায় তার পাজেরো জিপটিকে উদ্ধার করে জেলা পুলিশ।
পরদিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় শিবু লালকে উদ্ধার করে পুলিশ। জেলা পুলিশের অনুরোধে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ শুরু করে ডিএমপির গুলশান ডিবি। অবশেষে গতকাল অপহরণে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
হাফিজ আক্তার বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছাকাছি ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস অফিসে বসে পরিকল্পনা সাজায় অপহরণকারীরা। এতে অংশ নেয় ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির চালক জসিম। পরে একাধিকবার মিটিং ও অপারেশনাল পরিকল্পনা করে তারা।
এই মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেয় জসীম উদ্দীন মৃধা ও তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা। আগাম ১০ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয়। এছাড়া অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগসহ অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করার জন্য সাভার থেকে কেন হয় পাঁচটি বাটন মোবাইল ফোন। বেশি দাম দিয়ে কেনেন অন্যজনের নামে নিবন্ধন করা সিম। এরপর একটি খেলনা পিস্তল, দুইটি সুইচ গিয়ার চাকু, তিনটি চাপাতি ও গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি সংগ্রহ করে তারা। একাধিক দিন রেকি করে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টায় ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ করা হয় শিশু দাসকে।
১১ এপ্রিল দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হয়ে কার কোথায় কী দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেয় ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। আর ভুক্তভোগীর গতিবিধি জানানোর জন্য পিচ্চি রানা ও ল্যাংড়া মামুনকে মোটরসাইকেলে নিয়ে যায় গলাচিপা ঘাটে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেটকার ও একটা ট্রলি নিয়ে অবস্থান নেয় তাদের পাঁচ সহযোগী।
ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই একটি ট্রাক্টর ভাড়া করে চালক বিল্লাল। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটি নিয়ে চালক আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ এই চারজন অবস্থান নেন। ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে ড্রাইভার বিল্লাল ট্রলিটি নিয়ে সুকৌশলে ভুক্তভোগী শিবু দাসের জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেয়। পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকা চালক আশিক তার প্রাইভেট গাড়িটি দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির পেছনে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন।
পরে আশিক প্রাইভেটকার ছেড়ে ভুক্তভোগী শিবু দাসের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ, আশিক বেঁধে ফেলে তাদের। গামছা, টিস্যু পেপার ও স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চলাতে থাকে শারীরিক নির্যাতন।
বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে ভুক্তভোগীর জিপ থেকে তাদের তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া
প্রাইভেটকারটিতে। সেখানে দুজনকেই বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকানো হয়। আর ভুক্তভোগীর জিপটিকে আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসে তারা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধঘাট এলাকায় ভিকটিমদের বহনকারী গাড়ি বুঝে নেয়। এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিন ঘর কাম টর্চার সেলে নেওয়া হয় তাদের। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। রাতভর চলে নির্যাতন।
পর দিন রানার নির্দেশে বিল্লাল ভুক্তভোগীর সিম থেকে ভিকটিমের স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেয় অপহরণকারীরা।
এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তার ল্যাংড়া মামুন অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। ভগ্নিপতির টাকা মেরে পটুয়াখালী শহরে মালিক হয়েছে একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে তার দুটি টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত টাকা। মাওলানা হিসেবে তার বাবার সুখ্যাতি এবং পঙ্গুত্বের কারণে পঙ্গু এ ক্যাডারের ভয়ে এতদিন মুখ খোলেনি কেউ। তাদরে বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া তাদের নামে আরও একটি মাদক মামলা করা হবে।
এসএমএইচ
