সেই ছেলের করোনা জয়


অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭০ অবস্থায় করোনা আক্রান্ত মা-কে বাঁচানোর জন্য শরীরে ৮ লিটার মাত্রার চলমান ২০ কেজি ওজনের অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মোটরসাইকেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সেই সন্তান জিয়াউল হাসান টিটুও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। হাসপাতালে টানা ৬ দিন মায়ের সেবা করে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। অবশেষে টানা ১৫ দিন করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা টিটু।
আজ রবিবার দুপুরে তাঁর মোবাইলেফোনে করোনা নেগেটিভের রিপোর্ট আসে। বৃহস্পতিবার সে নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নমুনা দিয়েছিলেন। জিয়াউল হাসান টিটু বলেন, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। করোনা পজিটিভ থাকাকালে আমার শরীরে কোন উপসর্গ ছিলো না। তারপরেও টানা ১৫ দিন আমি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছি।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সব কাজ করেছি। এজন্যই দ্রত আমি সুস্থ হয়ে গেছি। টিটু বলেন, আমি সুস্থ হওয়ার পেছনে আমার মা রেহেনা বেগম ও ছোট ভাই রাকিবুল হাসান ইভানের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের সেবাযত্নে আমি এখন সম্পূর্ণ করোনা মুক্ত। মায়ের সেবা করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছি। এতে আমার কোন দুঃখ নেই। মমতাময়ী মাকে বাঁচাতে হবে, এটাই ছিল আমার একমাত্র চাওয়া। আমার সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসেছেন, আমি করোনা আক্রান্ত হয়েছি। সেই মা আমার সেবাযত্ন করেছেন।
১৫ দিন কিভাবে কাটল বাসায় : গত ২৩ এপ্রিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মাকে নিয়ে সেই মোটরসাইকেলে করেই নলছিটির সুর্য্যপাশা গ্রামের বাড়িতে ফেরেন ছেলে জিয়াউল হাসান টিটু। পরের দিন নলছিটি হাসপাতালে তাঁর পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়। সেই থেকে বাড়িতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুস্থ হয়ে ওঠেন টিটু।
১৫ দিন তিনি বই পড়ে ও ল্যাপটপে ইন্টার ব্যবহার করেই তাঁর সময় কাটে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাঁর কক্ষে খাবার দিয়ে আসতেন সেই মমতাময়ী মা রেহেনা বেগম ও ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগরে ছাত্র রাকিবুল হাসান ইভান। কোন কিছুর প্রয়োজন হলেই রিভান হাজির হয়ে যেতো টিটুর কাছে। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও শরীরে পিপিই পড়ে ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সেবা করেছে সে। মা ও ভাইয়ের প্রতি আজন্ম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে টিটু।
বিশিষ্টজনের ফোন : করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন জিয়াউল হাসান টিটুর খোঁজখবর নিতে তাঁর কাছে ফোন করেছিলেন কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। তিনি টিটুর সার্বিক মঙ্গল কামনা করেছেন, পাশাপাশি তাঁর মায়ের চিকিৎসার খোঁজখবরও নেন। সব সময় তাদের পাশে থাকার ঘোষণাও দেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক।
টিটু ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। এদিকে টিটুকে ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্মৃতি রানী ঘরামি, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া, কেন্দ্রীয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান শাহিন, দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. সাকলাইন, নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুম্পা সিকদার ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শিউলী পারভীন।
এছাড়াও সংবাদকর্মী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারাও ফোন করে সবসময় টিটুর খবর নিয়েছেন। টিটু তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মা রেহানা বেগমের কথা : মায়ের সেবা করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে টানা ১৫ দিন ঘরের ভেতরে ছিলেন টিটু। তাঁর সার্বক্ষণিক সেবাযত্ন করেছেন তাঁর মা নলছিটি বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেহেনা পারভীন। টিটুর বাবা মরহুম আব্দুল হাকিম মোল্লা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বাবার মৃত্যুর পরে ছেলেরাই মায়ের দেখাশুনা করেন। স্বামীকে হারানোর অভাব কখনোই বুঝতে দেয়নি তাঁর তিন ছেলে। বড় ছেলে মেহেদী হাসান মিঠু পুলিশের এসআই। সে খুলনার একটি থানায় কর্মরত আছে। রেহেনা বেগম বলেন, আমার সব স্বপ্নই এখন সন্তানদের ঘিরে। সন্তানরা যেমন আমার অসুস্থতার সময় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বাঁচানো চেষ্টা করেছেন, এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আমিও চাই তাঁরা আলোকিত মানুষ হোক। তাদের নিয়ে আমার গর্ব হচ্ছে, যেমনটি দেশের মানুষের হচ্ছে।
আমি যখন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি, তখন অনেক পত্রিকা ও টিভিতে আমার সন্তানকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। আমি দেখেছি সবগুলোই, আপ্লুত হয়েছি সন্তানদের এমন ভালোবাসায়। তাদের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। ১৭ এপ্রিলের ঘটনা : মা রেহেনা বেগমের অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক রাখতে শরীরের সঙ্গে গামছা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে রেখেছিলেন ছেলে জিয়াউল হাসান টিটু। মোটরসাইকেলের পেছনে করোনায় আক্রান্ত মা বসে আছেন।
সেই স্কুল শিক্ষিকা মা রেহেনা পারভীনকে লকডাউনের সময় মোটরসাইকেলে করে ১৭ এপ্রিল বিকেলে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর ছেলে। আর এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মহাসড়কে থাকা চেকপোস্ট থেকে সেই করোনা রোগী বহন করা মোটরসাইকেলটিকে দ্রত ও অবাধে যেতে দিয়েছে পুলিশ।
ওই সময় পুলিশের এক সদস্য একটি ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করে। এর পরেই ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। সেই মা রেহেনা পারভীন (৫৮) সুস্থ অবস্থায় গত ২৩ এপ্রিল বাসায় ফেরেন। রেহেনা পারভীন ঝালকাঠির নলছিটি বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবদুল হাকিম মোল্লার স্ত্রী।
জিয়াউল হাসান টিটু জানান, গত ৯ এপ্রিল তাঁর মার করোনা শনাক্ত হলে নলছিটির সূর্যপাশা বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ১৭ এপ্রিল দুপুরে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফোন দিলে অ্যাম্বুলেন্স অন্য রোগী নিয়ে বরিশাল চলে গেছে বলে জানানো হয়। লকডাউনের মধ্যে কোন গাড়ি যখন পাচ্ছিলেন না, তখন সংকটাপন্ন মায়ের জীবন বাঁচাতে মোটরসাইকেলে টিটু নিজের শরীরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে হাসপাতে নিয়ে আসেন।
এইচকেআর
