ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

জনপ্রিয় জিলাপির ইতিকথা

জনপ্রিয় জিলাপির ইতিকথা
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

মেলা উৎসব পার্বণে জিলাপির কদর কখনো কমেনি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে জিলাপির তুলনা দেওয়া হয়েছে নারীর মোহনীয় খোঁপার সঙ্গে। আমাদের মাদারগঞ্জ এলাকায় জিলাপি তৈরি করত ‘সদায়ওয়ালা’ সম্প্রদায়। বংশানুক্রমভাবে জিলাপি তৈরি ও বিক্রি করত তারা। ময়রা হিসাবে পরিচিত। তাদের তৈরি রসালো জিলাপি, বুন্দিয়া, গজা, কদমা, বাতাসা, সাজ, ঝুরি, কটকটি, দই, বাদমী ও মিষ্টি খুবই সুস্বাদু ছিল।

জিলাপি কি পুরোপুরি বাঙালির নিজস্ব খাবার নাকি ভিনদেশ থেকে বাংলায় এসেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বির্তক রয়েছে। শুরু করা যাক একটি বই দিয়ে; নাম ‘কিতাব-উল-তাবিখ’। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই রান্নার বইটি লেখা হয়েছিল দশম শতকের শুরুতে। এই বইতেই পারস্যের এক ব্যক্তি মুহম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদী উল্লেখ করেন একটি বিশেষ পদের। নাম ‘জুলবিয়া’। প্রায় একই সময় সায়ার অল-ওয়ারাকের লেখা আরবের রান্নার বইতেও নামটি পাওয়া যায়। এই জুলবিয়াই পরবর্তীকালে ভারতে এসে বদলে যায় ‘জালেবি’ বা বাংলায় ‘জিলাপি’-তে।

ইরানে জুলবিয়া পাওয়া যায়। বিশেষ করে পার্সিদের নববর্ষের দিন মিষ্টির এই পদটি প্রায় সব ঘরেই তৈরি করা হয়। অবশ্য কেবল নামেই নয়, চেহারাতেও জিলাপির সঙ্গে কিছু পার্থক্য রয়েছে। জুলবিয়া আড়াই প্যাঁচের নয়, বরং খানিক ফুলের মতো। ইরান থেকে আরেকটু মধ্যপ্রাচ্যে সরে এলে জুলবিয়া বদলে যাবে ‘জালাবিয়া’-তে। সাধারণত চিনির রসে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর জিলাপি পরিবেশন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের জালাবিয়ার ক্ষেত্রে চিনির রসের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় মধু ও গোলাপ-জল।

১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে জিনাসুরার লেখা জৈন গ্রন্থ ‘প্রিয়মকর্ণপকথ’-এ ভারতে জিলাপির উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন এর নাম ছিল ‘জলভাল্লিকা’ বা ‘কুণ্ডলিকা’। পরবর্তী বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থে (‘গুণাগুণবোধিনী’, ‘ভোজন কুতূহল’ ইত্যাদি) এখনকার জিলাপি তৈরির পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। মোঘলদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারে জিলাপি স্থান করে নিয়েছিল। ভোজনরসিক মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে একবার মিষ্টি রসের গোলাকৃতি, চক্রাকার প্যাঁচবিশিষ্ট খাবার হাজির করা হয়। সেটি খেয়ে তিনি এতই বিমোহিত হন যে, নিজের নাম জুড়ে দিয়ে তার নাম রাখেন ‘জাহাঙ্গিরা’। রাজকীয় এই মিষ্টিই জিলাপি।

মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিষয়ক গবেষক ক্লডিয়া রডেনের দাবি, ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগেই মিশরের ইহুদিরা হানুক্কাহ পালনের জন্য তৈরি করত ‘জালাবিয়া’, যেটি জিলাপিরই প্রাচীন রূপ। জিলাপির উত্পত্তি মূলত পশ্চিম এশিয়ায় এবং সেখান থেকেই মুসলিম বণিকদের হাত ধরে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে। ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে তুর্কি, ফারসি, আরব ও মধ্য এশীয় প্রভাবের কথা কারো অজানা নয়। তাই বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গ—দুই বাংলায় সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মিষ্টি। অ্যাংলো-ভারতীয় শব্দকোষ ‘হবসন-জবসন’-ও এ ধারণাকে আরো পাকাপোক্ত করে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতীয় শব্দ ‘জালেবি’ এসেছে আরবি শব্দ ‘জুলেবিয়া’ এবং ফারসি শব্দ ‘জুলবিয়া’ থেকেই; ‘জালেবি’ পরবর্তী সময়ে ‘জিলাপি’ হয়েছে।

জিলাপির আড়াই প্যাঁচের মতোই এর জন্ম-ইতিহাস। মুচমুচে শক্ত ভিতরে নরম তুলতুলে রসালো। বাঙালির প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে।


এমইউআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন