ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

Motobad news

সুদ দিতে দিতে সংসার চলে না প্রতিবন্ধী সোহাগের 

সুদ দিতে দিতে সংসার চলে না প্রতিবন্ধী সোহাগের 
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

জন্মগতভাবে স্বাভাবিক পা নেই। ছোট আকৃতির দুটি পা রয়েছে কোমরের কাছাকাছি। তার ওপর দুটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার আঘাত শারীরিক বৈকল্যতে পর্যবসিত করেছে। তবু কোনো কিছুই যেন দমিয়ে রাখতে পারেনি প্রতিবন্ধী সোহাগ হাওলাদারকে। প্রতিবন্ধী হলেও জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজেই কাজ করে আসছেন তিনি। 

বরিশাল নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ড জিয়া সড়কের প্রথম গলির আব্দুল আজিজের ভাড়াটে সোহাগ দুই মেয়ের বাবা। বড় মেয়ে সামিয়া ইসলাম নথুল্লাবাদ ক্যাডেট মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে সাদিয়া ইসলামের বয়স মাত্র দুই বছর। হাঁটতে যেখানে কষ্ট হয়, সেখানে মোটরচালিত রিকশায় ঘুরান জীবনের চাকা। করোনাকালীন অনেকটা অনাহারেই থাকতে হচ্ছে চার সদস্যের এই পরিবারকে। দ্বিতীয় দফার কঠোর লকডাউনে যখন রিকশা নিয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারতেন না, তখন দুর্দশার অন্ত থাকত না। বর্তমানে লকডাউন শিথিল হলেও যাত্রী কমে যাওয়ায় ‘টানাহেঁচড়া’ করে চলছে সংসার। 

তার ওপরে মহাজনের গাড়িভাড়া, কিস্তি, ঘরভাড়া আর দিনের বাজার; সবকিছুই দুর্ঘটনায় ভেঙে যাওয়া ঘাড়ে বয়ে টানছেন। সোহাগের মূল বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। তবে সপরিবার তারা বরিশালেই থাকতেন। সোহাগের শৈশবে তার বাবা শহীদ হাওলাদর দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান।

 তিনি বর্তমানে বরিশাল লাগোয়া জনপদ দপদপিয়া এলাকায় দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে থাকেন। বিপরীতে প্রতিবন্ধী সোহাগকে নিয়ে তার মা সংগ্রাম চালাতে থাকেন বরিশাল নগরীতে। সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রতিবন্ধী। 

তার ওপর দুটি দুর্ঘটনায় টাকাপয়সা সব হারিয়ে পথে বসেছি। মানুষের সুদের টাকা দিতে দিতে আমি শেষ। চিকিৎসার জন্য সুদে নেওয়া সাড়ে তিন লাখ টাকার ঘানি আজও টানছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, চায়ের দোকান ছেড়ে রিকশা চালানো শুরু করি। রিকশায় উঠতে গিয়ে পেটে চাপ লেগে ফুসফুসে ক্ষত হয়েছিল। সেই রোগ সেরে ওঠার পাঁচ-ছয় বছর আগে রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময়ে একটি বেপরোয়া মোটরসাইকেল পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমার ঘাড় ভেঙে যায়। তিনি জানান, দুটি হাত দিয়ে পুরো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আর ছোট পা দিয়ে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে রিকশার ব্রেক কষেন। 

রিকশাটিও নিজের না উল্লেখ করে বলেন, আমার যখন আয়-রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ, তখন এই এলাকার সবুজ ভাইয়ের কাছে গেলে তিনি মোটরচালিত রিকশা কিনে দেন। তবে রিকশার টাকা বাবদ দিনে ৩০০ করে জমা দিতে হয়। সোহাগ জানান, আজ সকালে ১৮০ টাকা রোজগার করেছি। বিকেলে হয়তো ২০০ থেকে ৩০০ হতে পারে। যা আয় হয়, সেটা দিয়েই দিনের বাজার করি। সোহাগের স্ত্রী লুৎফা বেগম বলেন, ১৩ বছর আগে প্রতিবন্ধী সোহাগের সঙ্গে ঘর বাঁধেন পরিবারের অমতে। লুৎফা বলেন, আমাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল দুই বছর। 

তারপর যখন বিয়ে করি, তখন দুই পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি। দুজনে শেষে শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসা নিয়ে থেকেছি। তারপর পরিবার মেনে নিয়েছে। কেন সোহাগের মতো চলাচলে অক্ষম একজন মানুষকে ভালোবেসেছেন, উত্তরে তিনি বলেন, ভালোবাসা তো এসব দেখে হয় না। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি, এখনো করছি। আজ তার ঘরে চাল নেই। সকালে যা পেয়েছে, সেই টাকায় এক কেজি চাল, ২৫০ গ্রাম বরবটি আর আধা কেজি গুঁড়া মাছ এনেছেন। 

এই দিয়েই দিন কেটে যাবে। বাসা ভাড়াসহ মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয় উল্লেখ করে বলেন, তার অসুস্থতার সময়ে যে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণী হয়ে যাই, সেই টাকা পরিশোধ করতে পারলে জীবনে আর কোনো দুঃখ থাকত না। এখন সুদ দিতে দিতে দিনের আয় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে মাসে ৭০০ টাকা পান। গত বছর করোনাকালে সরকার এবং অনেক দয়ালু মানুষ গরিবদের সহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এ বছর করোনায় কেউ কোনো সহায়তা দিচ্ছে না, রাস্তায় গাড়িও নামাতে পারছে না; নামলে যাত্রী নেই। লুৎফার প্রশ্ন, দ্যাশের দয়ালুরা সব গ্যাল কই? এমন হইলে মোরা খামু কি? বাচমু কেমনে? 


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন