গোলপাতা গাছের গুড়ে বছরে আয় ৬ কোটি টাকা


পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ লোনা জল ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে গোল পাতা। গোলপাতার ফলওয়ালা ডাঁটি কেটে রস আহরণ করা হয় গোলপাতার গুড় তৈরির জন্যে। গোলপাতা গাছের রস সংগ্রহ করে পাঁচ শতাধিক কৃষক পরিবার এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।
পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস হয়ে উঠছে গোলপাতা গাছ। এ উদ্ভিদ থেকে পাওয়া রসে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু গুড়। বছরে এখানকার গোলপাতা গুড়ের উৎপাদন প্রায় ৩০০ টন। যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৬ কোটি টাকা।
এ অঞ্চলের স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত অঞ্চলে জন্ম নেয় গোলপাতা। এর পাতা প্রায় ৩-৯ মিটার লম্বা হয়। বর্তমানে নীলগঞ্জ, চাকামইয়া, মিঠাগঞ্জসহ আটটি ইউনিয়নে প্রায় ৬৫ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে গোলপাতার। প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠছে এ সব গাছ। তেমন কোনো খরচ না থাকায় কেউ কেউ আবার নিজ উদ্যোগে বাগান বড় করছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব গুড়ের চাহিদা থাকায় স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ দেশের বাহিরে রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন তারা। দিনের পর দিন বাড়ছে এ গুড়ের চাহিদা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শীতের শুরুতেই বিকেলে গাছের ডগা কেটে হাড়ি পাতেন গাছিরা। সারা রাত হাড়িতে জমা রস কাকডাকা ভোরে সংগ্রহ করেন তারা। পরে চাতালে জাল দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। আর এসব গুড় গাছিরা বিক্রি করছেন ২০০ টাকা কেজি দরে। বিশেষ করে ডায়বেটিসে আক্রান্ত মানুষের কাছে লবনাক্ত এই গুড়ের চাহিদা ঢেরবেশি।
দৌলতপুর গ্রামের প্রবীণ হামিদ সিকদার বলেন, ‘আমার ডায়াবেটিসের জন্য সব ধরনের মিষ্টি খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন চিকিৎসক। তবে লবনাক্ত গোল গুড়ে সুগার কম থাকায় অমি মাঝেমধ্যেই গোলের গুড় সীমিত খেতে পারি। আমার তাতে সমস্যা হয় না।’
নীলগঞ্জ ইউপির নবীপুর গ্রামের গাছি বিমল হাওলাদার (৬৫) জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ অগ্রিম টাকা দিয়ে যায় গুড় কেনার জন্য। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের চাহিদা বেশি।
তিনি বলেন, ‘ক্রমাগত বাগান ধ্বংসের ফলে এখন ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে পারছি না।’
বিমলের দাবি, ‘বেড়িবাঁধের বাহিরে সরকারি খাস জমিতে গোল গাছ লাগিয়ে আমাদের দায়িত্ব দিলে রক্ষণাবেক্ষণসহ এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারতাম।’
একই গ্রামের ৮০ বছর বয়সী শিল্পি রানী বলেন, ‘৬০ বছর ধরে এই কাজ করছি। শুরুতে প্রতি ১০ থেকে ১৫ কলস রস পেতাম। এখন ৮ কলস পাই মাঝখানে বন্যার কারণে বাহড়ে ছড়া কম হতো এখন আবার হচ্ছে।’
নবীপুর গ্রামের গাছি নারায়ন মিত্র (৭৫) জানান, তার পূর্ব পুরুষ থেকে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই পেশায় নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
এই গাছির স্ত্রী শিখা মিত্র জানান, স্বামীর সঙ্গে কয়েক যুগ ধরে গুড় তৈরিতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যোগান দিয়ে আসছেন। বর্তমানে গোল গাছের সংকটে তাদের পেশা প্রায় পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছে।
তিনি বলেন, ‘এর আগে আমার ছেলে মেয়ে ও পুত্রবধূও এই কাজে সংশ্লিষ্ট ছিল। তারা এখন পেশার পরিবর্তন করে ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছেন।
গাছিরা বলছেন, প্রকৃতি রক্ষা এবং ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে বনায়নের পাশাপাশি গোলগাছ সংরক্ষনের বিকল্প নেই। খুব দ্রুতই সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এমআর সাইফুল্লাহ বলেন, ‘গোলগাছ মানুষের ঘরনির্মাণসহ প্রকৃতি রক্ষায় একটি বড় ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া গুড় থেকে বিশাল একটা অর্থ আয়ের পাশাপাশি হাজারো মানুষের ওপর নিভর্রশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এমনকি ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ সহনশীল পরিমাণে গোলগুড় খেতে পারে বলে আমরা জানতে পেরেছি। গোলবাগান রক্ষায় আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।’
পটুয়াখালী জেলা বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গোলবন সংরক্ষণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় আন্ধারমানিক নদী তীরসহ লোনাজল ভূমিতে গোলচারা রোপন করা হয়।
এএজে
